সময় কলকাতা ডেস্ক: একটা বাচ্চা ছেলে, ছোটবেলায় স্বপ্ন দেখতো। স্বপ্ন দেখতো কল্পনার ডানায় ভর করে অজানা কোন এক রহস্যময় উপত্যাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছে সে। কখনো বা নীল সমুদ্রের উপর পালতোলা জাহাজে করে দিনের পর দিন চলছে অজানার উদ্দেশ্যে। ছোটবেলা থেকেই অজানাকে জানার আগ্রহ ছিল ওই ছোট্ট ছেলেটির। স্বপ্নে অবলীলায় ঘুরে বেড়াতো ভয়ঙ্কর গিরিখাত এর পথ ধরে কখনো বা মৃত আগ্নেয়গিরির অভ্যন্তরে প্রবেশ করত। তার আগ্রহ ছিল জানার ,পৃথিবীর মধ্যে কি আছে? মহাকাশে ঘুরে বেড়ানো যায় কিভাবে এক তারা থেকে অন্য তারায় আলোর গতিবেগের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। ছেলেটির যত বড় হয়েছে ততই তার কল্পনার ডানা আরো দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়েছে। সেই কল্পনাকেই একদিন সে সাদা খাতার পৃষ্ঠায় অক্ষরের রূপ দেয়। সেই সম্মিলিত অক্ষরই একদিন রূপ নেয় অসাধারণ কল্পবিজ্ঞানের সাহিত্যের। ছেলেটির নাম জুল ভার্ন। যাকে বলা হয় কল্পবিজ্ঞানের জনক।
কিন্তু কেন তাকে কল্প বিজ্ঞানের জনক বলা হয়।
উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে সমাজের কল্যাণ সাধন করেছিল জড়বাদী বিজ্ঞান। কিন্তু আরো কিছু যেন করণীয় ছিল ।আর সে কথাই উপলব্ধি করেছিলেন জুল ভার্ন। জুলভার্ন যখন যুবক তখন ট্রেন আর কলের জাহাজ মানুষের যাতায়াতের প্রয়োজনে ব্যবহৃত হতো ।কিন্তু শূন্য পথে পরিভ্রমণ এক কথায় বলতে গেলে তখন ছিল আকাশকুসুম পর্যায়ে। কিন্তু জুলভার্ন তার কল্পবিজ্ঞানের কাহিনীতে অ্যান্টি গ্রাভিটি থিওরি কে কাজে লাগিয়ে লিখে ফেলেছিলেন একের পর এক উপন্যাস, যে উপন্যাসের প্রতিটি ছত্রে লেখা রয়েছে কিভাবে সম্ভব আকাশে ওড়া। “রোবার দি কনকারার” উপন্যাসে তিনি যে আকাশে পরিভ্রমণের যন্ত্রের বর্ণনা দিয়েছেন সেই যন্ত্রের বর্তমান সমাজের রূপ হল ড্রোন।
সেই সময় বেলুনে করে ওড়া ছিল কল্পনার অতীত কিন্তু তাঁর উপন্যাস “ফাইভ উইকস ইন এ বেলুন” এ হাতে-কলমে প্রমাণ দিয়েছিলেন কি করে আকাশে ওড়া সম্ভব।বিখ্যাত শিল্পী লিওনার্দো দা ভিঞ্চির আঁকা উড়ন্ত যানের ড্রইং সারাবিশ্বে সুবিখ্যাত। তারই পটভূমিকায় জুলভার্নের রচনা “অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড ইন এইট্টি ডেজ” ।
যে উপন্যাসের প্রতিটি ছত্রে বিজ্ঞানের জ্ঞান আর তার বাস্তব প্রয়োগ এর ব্যাখ্যা রয়েছে। তখনো ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাত এর উৎসমুখ আবিষ্কৃত হয়নি। কিন্তু জুলভার্নের এই লেখায় যে বর্ণনা ছিল অর্থাৎ তার কল্পনায় যে বর্ণনা দিয়েছিলেন তাঁর দীর্ঘ কয়েক বছর বাদে সেই উৎসমুখ আবিষ্কার হয়েছিল। রচনাশৈলী এবং রচনা সংখ্যা দুদিক থেকেই অসাধারণ লেখক ছিলেন জুল ভার্ন। তার প্রতিটি লেখায় পাঠক নিজেকে গল্পের সঙ্গে আত্মস্থ করে নিতে পারতেন সহজেই।
1863 সালে জুলভার্ন রচনা করলেন তাঁর অসাধারণ উপন্যাস “এ জার্নি টু দ্য সেন্টার অব দি আর্থ”ভূ কেন্দ্রের রহস্য আজও আমাদের কাছে অজ্ঞাত কিন্তু জুলভার্নের বর্ণিত দীর্ঘ পাতাল সুরঙ্গ ,মাটির নিচের পাথরের স্তর, মাটির নিচে জলের সম্ভার সবই কিছু যেন বৈজ্ঞানিক জ্ঞানে সমৃদ্ধ।
তার কিছুদিন পরেই জুল ভার্ন লিখলেন এক অসাধারণ উপন্যাস “এ জার্নি ফ্রম দি আর্থ টু দি মুন” । এই উপন্যাসের প্রতি পাতায় পাঠকের বিশ্বাস আনার জন্য একাধিক বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের প্রয়োগ করেছেন। পৃথিবী থেকে উপগ্রহে পরিভ্রমণ যে অসম্ভব নয় ,সে কথাও প্রমাণ করেছিলেন এই উপন্যাসে। তার বহুদিন বাদে চাঁদের মাটিতে পা রেখেছিল মানুষ। তার উপন্যাস “ডক্টর এক্স এক্সপেরিমেন্ট “এবং” পারচেস অফ দি নর্থ পোল”উপন্যাসও বিজ্ঞানের জ্ঞানে সমৃদ্ধ , প্রতিটি বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব পরে প্রমাণিত হয়েছে।1967 সালে জুলভার্নের আরেকটি উপন্যাস “এ ফ্লোটিং সিটি”। জাহাজে করে আমেরিকা গমনের স্মৃতিচারণা নিয়ে এই উপন্যাস পাঠকের মনে গভীর দাগ কেটেছে।
জুলভার্নের একটি নিজস্ব একটি জাহাজ ছিল “সেন্ট মাইকেল ” ।যে জাহাজে করে তিনি একাধিকবার সমুদ্রে পাড়ি দিয়েছিলেন ।আর তার ঠিক তার পরেই তিনি লিখেছিলেন তার জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস “টুয়েন্টি থাউজেন্ড লীগস আন্ডার দ্য সী”। যে উপন্যাসের বিখ্যাত চরিত্র ক্যাপ্টেন নিমো এবং ডুবো জাহাজের নাম ছিল নটিলাস। এই উপন্যাসে ডুবোজাহাজের যে বর্ণনা এবং তার যে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা অর্থাৎ কি পদ্ধতিতে জল নিষ্কাশন করে ডুবোজাহাজ কে উপরে তোলা যাবে এবং জল ভরিয়ে কিভাবে ডুবোজাহাজ কে জলের নিচে নিয়ে যাওয়া হবে এবং কত ফ্যাদম চলে গেলে জলের চাপ কত থাকবে। সবই বিজ্ঞানের অংকে ব্যাখ্যা করেছিলেন জুল ভার্ন। ডুবোজাহাজ এ কিভাবে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হবে, ডুবোজাহাজ কিভাবে চলবে তার সঠিক ব্যাখ্যা ছিল এই উপন্যাসে। এই উপন্যাস রচনার দীর্ঘ যুগ বাদে আমেরিকা প্রথম সাবমেরিন তৈরি করে। যে সাবমেরিনের নাম জুলভার্নের স্মরণে দেওয়া হয় নটিলাস। তার আরও জনপ্রিয় উপন্যাস “মিস্টিরিয়াস আইল্যান্ড”,” ড্রপ ফ্রম দি ক্লাউডস “,” দি সিক্রেট অফ আয়ারল্যান্ড” । মিস্টিরিয়াস আইল্যান্ড গল্পে যে সকল চরিত্র একটি দ্বীপে আশ্রয় নিয়েছিল। সেই সব চরিত্রের মধ্য দিয়ে এবং তাদের কার্যপ্রণালীর মধ্য দিয়ে এক একটি বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার এবং তার বিশ্লেষণ জুল ভার্ন বৈজ্ঞানিকের মতন দিয়েছিলেন। কিভাবে বিস্ফোরক তৈরি করা যায়, কিভাবে চশমার কাঁচ দিয়ে আগুন জ্বালানোর সম্ভব, সব কিছুতেই ছিল নিখুঁত বিজ্ঞানের বর্ণনা।
জুলভার্নের আরও বিখ্যাত অনেক উপন্যাসে ছিল “ভেনিস ডায়মন্ড “,”দ্য স্টিম হাউস”,” দি বেগমস ফরচুন”,,”দা মাস্টার অফ দি ওয়ার্ল্ড”এইসব উপন্যাসেও ছিল একাধিক বিজ্ঞানের থিওরি । জুলভার্ন তার একাধিক উপন্যাসের যে সমস্ত বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ব্যবহার করেছিলেন সেই সমস্ত বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব, তার উপন্যাস রচনার দীর্ঘ যুগ বাদে আবিষ্কার হয়েছিল। সে কারণেই আজও জুলভার্ন কে বলা হয় কল্পবিজ্ঞানের জনক। শুধু কল্পবিজ্ঞান নয় আদতে বলতে গেলে জুলভার্ন ছিলেন একজন বৈজ্ঞানিক লেখক।
জুলভার্নের জীবন আর তার সাফল্যের রহস্য
জুলভার্নের জন্ম নামতেসে।1828 সালের ফেব্রুয়ারি মাসের 8 তারিখে জন্মগ্রহণ করেন জুল ভার্ন। বাবা পিয়েরী ভার্ণ ছিলেন পেশায় আইনজীবী। মায়ের নাম সোফিয়া। জুল ভার্নও বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করে প্যারিসে গিয়ে আইন পড়েন এবং ব্যারিস্টার হন। প্রথমে থিয়েটারের জন্য লেখালেখি শুরু করলেও পরে তিনি কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যে ঢুকে পড়েন। একটা সময় প্রবল অর্থাভাবে কেটেছে জুলভার্নের, ছাত্র পড়িয়ে তাকে করতে হয়েছে অর্থ উপার্জন। 1857 সালে তিনি প্রথম ভ্রমণ কাহিনী লেখা শুরু করেন।1862 সালে তার কল্পবিজ্ঞানের প্রথম উপন্যাস ছিল “ফাইভ উইকস ইন এ বেলুন”।
প্রথমে প্রকাশকেরা এই উপন্যাস ছাপতে রাজি হয়নি। ফলে রাগে-দুঃখে তিনি তার উপন্যাসকে ছিঁড়ে আগুনে জ্বালিয়ে দিতে চেয়ে ছিলেন। কিন্তু তার স্ত্রী সে যাত্রায় রক্ষা করেছিল সেই উপন্যাস। তার সেই উপন্যাস পড়ে এম হটেজল নামক এক প্রকাশক প্রকাশ করেছিল । তারপর থেকে আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি জুলভার্ন কে। তারপরেই জুলভার্নের কলম থেকে একের পর এক রচনা হয়েছে একাধিক কালজয়ী উপন্যাস। সাহিত্যে সেবার জন্য ফরাসি একাডেমি তাকে সম্মানিত করেছিলেন “লিজিয়ন অব অনার “মেডেল দিয়ে। শেষ জীবনে অন্ধত্ব আর বধিরতা তার কলম এর গতি রুদ্ধ করে দিয়েছিল।1905 সালের 28 শে মার্চ আমিয়েন্স শহরে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন।
More Stories
প্রশাসক হিসেবে কতটা সফল হবেন মুহাম্মদ ইউনুস?
নেলসন ম্যান্ডেলা কেন মহাত্মা গান্ধীর চেয়ে পৃথক ধারার আন্দোলন ও মতের শরিক এবং পথিক?
বাঙালি পর্যটকদের জন্য : গরমে কাছেই ঝান্ডি ঘুরে আসুন, স্বস্তি মিলবে