সময় কলকাতা ডেস্ক: এই পৃথিবীতে রয়েছে অসংখ্য রহস্য। যে রহস্যের সমাধান আজও হয়নি ,সেই রহস্য আজ মিথ এ পরিণত হয়েছে। মৃত্যুর 56 বছর বাদেও যার অস্তিত্ব সিকিমের পাহাড়ের আনাচে-কানাচে রয়ে গিয়েছে। সিকিমের পাহাড়ের প্রতিটি গল্পকথায় রয়েছে বাবা হরভজন সিং। কি সেই গল্পকথা ?যে গল্পকথা প্রতিটি পাহাড়বাসী অন্তর থেকে বিশ্বাস করে।
1946 সালের 30 শে আগস্ট গুজরাওয়ালা গ্রামে জন্ম হয়েছিল হরভজন সিংয়ের। এই গুজরাওয়ালা গ্রাম বর্তমানে পাকিস্তানে অবস্থিত। মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মের পর থেকে বেড়ে ওঠা হরভজন সিং যুবক বয়সে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। সময়টা 1966 সাল ,পাঞ্জাব রেজিমেন্ট যোগদানের পর কিছুদিনের মধ্যেই হরভজনকে পাঠানো হয় সিকিমে। কিছুদিন কর্তব্যরত অবস্থায় আচমকাই হরভজন সিং একদিন সন্ধায় নিখোঁজ হয়ে যান। ওই দিন তিনি ডুকালা থেকে ডেঙ্গচুইলা যাচ্ছিলেন কিছু ঘোড়া নিয়ে। ওই রাতেই নিখোঁজের পর, সেনাবাহিনী খোঁজাখুঁজি করেও তার সন্ধান না পেয়ে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় সেনা বাহিনীর কঠোর পরিশ্রম থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য পালিয়ে গিয়েছেন হরভজন সিং। কিন্তু পরের দিন রাতে ঘটে এক অদ্ভুত ঘটনা। এক সেনাবাহিনীর জওয়ানের স্বপ্নে আসেন হরভজন সিং। স্বপ্নে ওই জওয়ানকে হরভজন সিং বলেন তার মৃতদেহ কোথায় পড়ে আছে এবং তিনি ঘোড়া সমেত প্রবল স্রোতস্বিনী এক নালাতে পড়ে গিয়েছিলেন। পরের দিন ওই সৈনিকের কথা শুনে সার্চ অপারেশান করে সেনাবাহিনী। স্বপ্নে বলা ওই নির্দিষ্ট জায়গা থেকেই হরভজন সিংয়ের মৃতদেহ এবং তার রাইফেল উদ্ধার হয়।
তখনই প্রশ্ন ওঠে প্রবল স্রোতস্বিনী নালাতে পড়ে যাওয়ার পরেও মৃতদেহ এবং রাইফেল একই জায়গায় কি করে আসলো। এই রহস্যের সমাধান হওয়ার আগেই আর এক জওয়ানের স্বপ্নে আসেন হরভজন সিং। স্বপ্নে তিনি বলেন তার মৃত্যু হয়েছে ঠিকই কিন্তু তিনি সর্বদাই সেনাবাহিনীর হয়ে কর্তব্যরত অবস্থায় থাকবেন সমগ্র পাহাড় জুড়ে। প্রথম প্রথম একথা বহু মানুষ হাসির খোরাক হিসেবেই ধরে নিয়েছিল। কিন্তু কিছুদিন যেতেই হরভজন সিংয়ের এই কথা প্রতিটা মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করে। মূলত রাতের বেলায় সিকিমের বরফ আচ্ছাদিত পর্বত শৃঙ্গে কঠিন পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনীর জওয়ানরা বিপদে পড়লেই হরভজন সিংয়ের উপস্থিতি অনুভব করত।
পাহাড়ের কোন মানুষ রাতের বেলায় পথ হারিয়েছে সেই বিপদগ্রস্ত মানুষের পাশে আচমকাই আর একজন মানুষকে দেখা যেত ।যে হঠাৎ আবির্ভূত হয়ে সঠিক রাস্তা নির্দেশ করে মিলিয়ে যেত পাহাড়ের গহীন অন্ধকারে। হয়তো কোনো সেনাবাহিনীর জওয়ান কর্তব্যরত অবস্থায় রাতের বেলায় ঘুমিয়ে পড়েছে, আচমকাই তার গালে পড়তো সপাটে চড়। এমন অসংখ্য গল্পকথা ছড়িয়ে আছে সিকিমের পাহাড়ের আনাচে-কানাচে। শুধু তাই নয় হরভজন সিংয়ের অস্তিত্ব মেনে নিয়েছে ভারত চীন সীমান্তের কর্তব্যরত চিনা সৈনিকেরাও। চিনা সৈনিকদের মতে বহু সময় তারা দেখতে পেয়েছেন একজন ভারতীয় সেনা ঘোড়ার পিঠে চড়ে চীন ভূখণ্ডে ঘুরে বেড়াচ্ছেন এবং সেই সংক্রান্ত রিপোর্ট তারা ভারতীয় সেনাবাহিনীকে একাধিকবার জানিয়েছে।
এই সমস্ত ঘটনার পর থেকেই হরভজন সিং হয়ে যায় পাহাড়ের মানুষ আর সেনাবাহিনীর কাছে বাবা হরভজন সিং। মৃত্যুর পরেও হরভজন সিংয়ের অন ডিউটি থাকাকে মান্যতা দেয় সেনাবাহিনী। সেনাবাহিনীর পরিতক্ত বাঙ্কার কে সাজিয়ে গুজিয়ে গড়ে তোলা হয় বাবা হরভজন সিংয়ের মন্দির। নাথুলা পাস থেকে কিছুটা উপরে গেলেই বাবার মন্দির। যে মন্দির দর্শন করার জন্য সারা বছর ধরে দর্শনার্থীদের ভিড় লেগেই থাকে। বাবা হরভজন সিংয়ের মন্দির হরভজন সিংয়ের ইউনিফর্ম জুতো বেল্ট এবং ব্যবহারের সমস্ত জিনিসপত্র সাজিয়ে রাখা হয়েছে। পুরোহিত দিয়ে পুজো করা হয় প্রতিনিয়ত।
মৃত্যুর পরেও কর্তব্যরত থাকাকে সেনাবাহিনী মান্যতা দিয়ে তার বেতন নির্দিষ্ট সময়ে তার পরিবারের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হতো। প্রতি বছরে দুই মাসের জন্য হরভজন সিংয়ের ব্যবহৃত সমস্ত জিনিস একটি ট্রেনের কামরা সম্পূর্ণ বুক করে পাঠানো হতো তার বাড়িতে। অর্থাৎ বছরে দুই মাসের জন্য হরভজন সিংকে তার কর্তব্য থেকে অব্যাহতি দিয়ে ছুটিতে পাঠানো হতো। নির্দিষ্ট সময়ে হরভজন সিংয়ের বেতন বৃদ্ধি করা হতো এবং সেনাবাহিনীর সমস্ত ইনক্রিমেন্ট চালু ছিল হরভজন সিংয়ের জন্য। কয়েক বছর আগেও হরভজন সিং মৃত্যুর পরেও সেনাবাহিনীতে কর্তব্যরত অবস্থায় ছিলেন। তার পরেই তিনি নিয়েছেন নির্দিষ্ট প্রথামাফিক অবসর। সেনাবাহিনী থেকে অবসর নিলেও আজও রাতের বেলা নাথুলা পাস সহ আশেপাশের অঞ্চলে কর্তব্যরত অবস্থায় রয়েছেন বাবা হরভজন সিং।
আমার সৌভাগ্য হয়েছে বাবা মন্দির দর্শন করবার।
ধন্যবাদ