Home » বীর শহীদ তিতুমীরের অজানা ইতিহাস

বীর শহীদ তিতুমীরের অজানা ইতিহাস

পুরন্দর চক্রবর্তী, সময় কলকাতা :

১৭৮১ সালের ২৭ জানুয়ারি উত্তর চব্বিশ পরগনার প্রত্যন্ত প্রান্ত হায়দারপুরে জন্মেছিলেন বাংলার এক বীরসন্তান তিতুমীর। স্বাধীনচেতা বীর নেতা তিতুমীর প্রাণ দিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামের ভাবনা জাগিয়ে তুলছিলেন স্বদেশবাসীর মনে ।জমিদারদের বিরুদ্ধে কৃষক বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন তিনি । ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের ইতিহাসের আদি অধ্যায়ে লেখা আছে তাঁর নাম।বাঁশের কেল্লা গড়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের আগুন জ্বালানো তিতুমীরের জন্মদিনেও অনুষ্ঠান উদযাপনের বেশি কিছু হয় না আজও ।

প্রকৃত নাম সৈয়দ মীর নিসার আলী হলেও তিনি তিতুমীর নামেই বেশি পরিচিত।তারিখ-ই-মুহাম্মাদিয়ার নেতা, তিতুমীর,তাঁর অনুগামীদের সঙ্গে উত্তর চব্বিশ পরগণার বসিরহাট মহকুমার নারকেলবেড়িয়ায় একটি দুর্গসম বাঁশের কেল্লা  তৈরি করেছিলেন। ব্রিটিশ সৈন্যদের দুর্গে অবরোধের পর,১৮৩১ সালের নভেম্বরে তিতুমীর ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধে মারা যান। কিন্তু মৃত্যুর ১৯১ বছর পরেও, বইয়ের পাতায় উল্লেখ ছাড়া বীর যোদ্ধা তিতুমীরের কার্যত কোনো স্মৃতিই আর অবশিষ্ট নেই। অথচ তিনি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রামের গোড়ায় সংগঠিত বিপ্লব শুরু করেছিলেন।যদিও বারাসাতে তিতুমীর বাস স্ট্যান্ড যা ২০০৪ সালের জানুয়ারিতে তৈরি হয়েছিল , তার নামে নামকরণ করা হয়েছে তথাপি উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলায় বা রাজ্যে সেঅর্থে কিছুই করা হয় নি তাঁর স্মৃতিরক্ষার্থে।

তিতুমীরের ২৪১ তম জন্মদিন উপলক্ষে বাঁশেরকেল্লার পূণ্যভূমিতে তিতুমীরের নিজস্ব ভাবনা অনুযায়ী বাঘের মুখের ছবি সম্বলিত শহীদ তিতুমীর মিশনের পতাকা উত্তোলন করেন রামচন্দ্রপুর উদয় গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান নুর ইসলাম লস্কর ও শহীদ তিতুমীর মিশনের সম্পাদক রবিউল হক।কিছু দাবী ও কিছু আশ্বাস – এই ছিল বীর শহীদের জন্মদিন উদযাপনের অঙ্গ।

বাদুড়িয়ার সমষ্টি উন্নয়ন আধিকারিক এই উপলক্ষ্যে সুপর্ণা বিশ্বাস এই উপলক্ষ্যে জানান, এলাকার মানুষের দাবি অনুযায়ী, নারকেলবেড়িয়ার কারবালা ও তিতুমীরের এই পূণ্যভূমিতে আগত মানুষদের সুবিধার জন্য এখানে একটি পানীয় জল ও শৌচাগার এবং দুটি জোরালো আলোক উৎসের শীঘ্রই কাজ শুরু হবে। আশ্বাস দুর্ভাগ্যজনক ভাবে স্রেফ কিছু শব্দ হয়েই থেকে যাচ্ছে।

নারকেলবেড়িয়া তিতুমীর স্মৃতি সংঘ এর পরিচালনায় তিতুমীরের জন্মদিনের একটি বিশালাকৃতি কেক কাটা হয়। এই অনুষ্ঠান মঞ্চ থেকে শহীদ তিতুমীর মিশনের সম্পাদক রবিউল হক দাবি তোলেন, ঐতিহ্যমণ্ডিত গ্রাম হিসেবে নারকেলবেড়িয়া ও তিতুমীরের জন্মস্থান হায়দারপুর- চাঁদপুর গ্রাম দুটিকে হেরিটেজ করা হোক। একই সঙ্গে তিতুমীরের দরিদ্র বংশধররা স্বাধীনতা সংগ্রামীর পরিবার হিসেবে যাতে সরকারি ভাতা পায় তার ব্যবস্থা করা হোক। সেইসঙ্গে মসলন্দপুর থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত তিতুমীর সরণি নাম দিয়ে নারকেলবাড়িয়া ঢোকার মুখে তিতুমীরের নামে একটি স্থায়ী তোরণ তৈরি করা হোক। দাবী দাওয়াও দীর্ঘদিনের।

জন্মদিন উপলক্ষে শহীদ তিতুমীর স্মৃতি সংঘ দুদিনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। বৃহস্পতিবার উদ্বোধনী দিনে আটঘরা বিকাশ কেন্দ্রের সহযোগিতায় স্থানীয় মেয়েদের আদিবাসী নৃত্য পরিবেশন করা হয়। সবমিলিয়ে দাবী ও আশ্বাস,নাচ আর ক্রীড়া প্রতিযোগিতা নিয়ে স্মরণ উদযাপন হল নিষ্ঠাভরে।

জন্মদিন ঘটা করে পালন করা হলেও মুষ্টিমেয় মানুষই জানেন যে তিতুমীর এবং নারকেলবেড়িয়ার ইতিহাসে আরও অনেক কিছু রয়েছে।  নারকেলবেরিয়ার যুদ্ধ এই অঞ্চলের স্থানীয় ইতিহাসের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে আছে।বর্তমানে নারকেলবেড়িয়ায় দেখার মতো কিছুই নেই। বাঁশের কেল্লার কোন নিদর্শন নেই যা ব্রিটিশ বাহিনী ধ্বংস করেছিল। সেখানে শুধু একটি স্তম্ভ এবং যোদ্ধাদের কিছু জরাজীর্ণ সমাধি রয়েছে।

তিতুমীর সম্পর্কে খুব বেশি না জানা গেলেও কিছু তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভবপর হয়েছে।তিতুমীর হায়দারপুরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন । তিতুমীর কুরআনের একজন হাফিজ ছিলেন এবং ১৮২২ সালে মক্কায় যান। ফিরে এসে তিনি ধর্মপ্রচার শুরু করেন এবং মুসলমানদেরকে ইসলামিক জীবনধারা অনুসরণ করার পরামর্শ দেন কিন্তু শীঘ্রই তিনি জমিদার কৃষ্ণদেব রায়ের সাথে সাধারণের উপর কর আরোপের জন্য বিরোধে জড়িয়ে পড়েন। মানুষ কৃষকদের উপর নিপীড়নের জন্য তিতুমীর গোবরা গোবিন্দ পুরের দেবনাথ রায় এবং গোবরডাঙ্গার কালীপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায়ের মত অন্যান্য জমিদারদের সাথেও দ্বন্দ্বে জড়িয়েছিলেন। ব্রিটিশ আধিপত্য থেকে দেশকে মুক্ত করার চূড়ান্ত উদ্দেশ্য নিয়ে তিতুমীর নিপীড়নকে প্রতিহত করেছিলেন।

তিনি নিপীড়নের বিরুদ্ধে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে অভিযোগ দায়ের করেন কিন্তু কোনো ফল হয়নি। তিনি কৃষকদের সুরক্ষা দেওয়ার জন্য একটি মুহাজিদ বাহিনী গঠন করেন।তিনি নিজেকে বাদশাহ ঘোষণা করেন এবং জমিদারদের কাছ থেকে কর দাবি করেন৷ কলকাতা থেকে একটি ইংরেজ বাহিনী পাঠানো হয়েছিল কিন্তু বাহিনীটি এসে পর্যুদস্ত হয়ে ফিরে যায় ।পরবর্তীতে লর্ড বেন্টিঙ্ক অশ্বারোহী বাহিনী, পদাতিক এবং কামান নিয়ে গঠিত একটি নিয়মিত সেনাবাহিনী পাঠান। তিতুমীরের মুজাহিদরা আক্রমণ প্রতিহত করতে ব্যর্থ হয়। বাঁশের কেল্লা ধ্বংস হয়ে যায়। তিতুমীরের সেনাপতি গোলাম মাসুমকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। তিতুমীর যুদ্ধে  ক্ষতবিক্ষত হন ও মৃত্যুবরণ করেন (১৯ নভেম্বর, ১৮৩১)। ইতিহাসের পাতায় এনিয়ে বহু কাহিনী লেখা হলেও এলাকায় একটি স্তম্ভ ছাড়া তিতুমীরের কোনো স্মৃতি নেই। বিদেশ থেকে আসা পর্যটক এবং নারকেলবেড়িয়ায় আসা ইতিহাসের শিক্ষার্থীরা হতাশ হতে পারেন তবে ১৯৭২ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সতিময় রায় যুদ্ধক্ষেত্রের কাছে তাঁর নামে একটি স্তম্ভ স্থাপন করেছিলেন। স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, প্রাচীন যুদ্ধক্ষেত্রটি সরকারের দখল নেওয়া উচিত। তাঁদের অভিযোগ যে বিভিন্ন সময়ে শাসক দল  অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছে কিন্তু কেউ  কথা রাখেনি। তারা তিতুমীর স্মৃতি কমিটি গঠন করে একটি জাদুঘর প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়ে আসছেন । এছাড়া জন্মদিনে উঠছে অনেক দাবী। ঐতিহ্য রক্ষার উদ্যোগ মৌখিক প্রতিশ্রুতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে গেছে।।

About Post Author