পুরন্দর চক্রবর্তী, সময় কলকাতা,১১ জুন : চতুর্থ দফার লোকসভা নির্বাচনে বঙ্গে যে আট কেন্দ্রে নজর থাকছে তারমধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য ও নজরকাড়া কেন্দ্র বর্ধমান-দুর্গাপুর। এখানে ত্রিমুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতা। বর্ধমান দুর্গাপুর কেন্দ্রে অবশ্যই বামেদের বরাবরই একটা পকেট ভোট রয়েছে, সুকৃতি ঘোষাল এবারও এখানে সিপিএমের ভোটে লড়ছেন কিন্তু নজর থাকছে দুই হাই -প্রোফাইল প্রার্থী দিলীপ ঘোষ ও কীর্তি আজাদের। পদ্মের দিলীপ নাকি ঘাসফুলের কীর্তি – আলোচনা বঙ্গ জুড়ে এমনকি বঙ্গ ছাড়িয়ে। দেখে নেওয়া যাক বর্ধমান-দুর্গাপুর লোকসভা কেন্দ্রের হাল হকিকত।
বর্ধমান- দুর্গাপুর কেন্দ্রে ২০২১ সালে জয়ী হয়েছিলেন বিজেপির সুরেন্দ্রজিত সিং আলুওয়ালিয়া। তিনি পান ৫ লক্ষ ৯৮ হাজার ভোট আর তৃণমূলের প্রাক্তন সাংসদ মমতাজ সংঘমিত্রা পেয়েছিলেন ৫ লক্ষ ৯৫ হাজারের বেশি ভোট। জয় পরাজয়ের ব্যবধান ছিল মাত্র ২ হাজার ৪৩৯। ২০১৪ সালে আবার মমতাজ সংঘমিত্রা হারিয়ে দিয়েছিলেন ২০০৯ সালে এই কেন্দ্রে বিজয়ী বাম প্রার্থী সাইদুল হককে। অর্থাৎ সাম্প্রতিক অতীতে বর্ধমান – দুর্গাপুর কেন্দ্রের চরিত্রে রয়েছে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে রাজনৈতিক দলগুলিকে কাজের সুযোগ দেওয়া। এই কেন্দ্রের অধীনে বিধানসভা গুলিতেও এরকম পরিবর্তন-মুখী চরিত্র রয়েছে।এই কেন্দ্রের অধীনে রয়েছে যে সাতটি বিধানসভা কেন্দ্র সেগুলি হ’ল – দুর্গাপুর পূর্ব, দুর্গাপুর পশ্চিম, গলসি, ভাতার, বর্ধমান উত্তর,বর্ধমান দক্ষিণ ও মন্তেশ্বর। দুর্গাপুর পশ্চিম কেন্দ্রেও এই পরিবর্তনমুখী চরিত্র পরিষ্কার। ভোটাররা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সুযোগ দিয়েছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে। ২০২১ সালে এখানে বিজেপি জিতেছিল। দুর্গাপুর পুরসভার ১১ থেকে ২২ ও ২৯ থেকে ৪৩নম্বর ওয়ার্ড অর্থাৎ ২৭টি ওয়ার্ড এই কেন্দ্রে রয়েছে। সিপিএমের মৃণাল ব্যানার্জীর জয়ের হ্যাটট্রিক করার পরে ২০১১ সালেও সিপিএম এখানে ভালো ভোট টেনেও তৃণমূলের কাছে হেরে যায়। ২০১৬ সালে এখানে কংগ্রেস জিতে যায়,২০২১ সালে এখানে প্রথমবার ফোটে পদ্মফুল। এরকম ছবি বাকি বিধানসভা কেন্দ্রেও। দুর্গাপুর পূর্ব বিধানসভা কেন্দ্রে রয়েছে দুর্গাপুর পুরসভার ১ থেকে ১০ নম্বর ওয়ার্ড এবং ২৩ থেকে ২৮ নম্বর ওয়ার্ড অর্থাৎ ১৬ টি ওয়ার্ড নিয়ে গড়ে উঠেছে দুর্গাপুর পূর্ব। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে তিনহাজারের সামান্য বেশি ভোটের ব্যবধানে বিজেপি প্রার্থী দীপ্তাংশু চৌধুরী হেরে যান তৃণমূলের প্রদীপ মজুমদারের কাছে। নইলে দুর্গাপুর পূর্বেও ফুটতে পারত পদ্মফুল। তৃণমূল ২০২১ সালে জিতলেও ২০১৬ সালে এখানে সিপিএম জয়ী হয়।২০১১ সালে আবার এখানে জয়ী হয়েছিল তৃণমূল। অর্থাৎ সেই পরিবর্তনমুখিতা। বলা হয়, কেরলে এরকম করেই ভাবেন ভোটাররা। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে রাজনৈতিক দলগুলিকে কাজের সুযোগ করে দেন । দুর্গাপুর শহর ও শহরতলী যেন একটুকরো কেরল।
দুর্গাপুর শহর ছাড়ালেও এই চিত্র কমবেশি রয়েছে এই কেন্দ্র জুড়ে। ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে গলসিতে বামেরা জিতেছিল। তারপর থেকেই তৃণমূলের আধিপত্য। বর্ধমান উত্তরে গলসির মত একই চিত্র। বাম শাসনের অবসান ঘটিয়ে ২০১৬ ও ২০২১ সালে এখানে জেতে তৃণমূল। বাকি তিনটি বিধানসভা কেন্দ্রে অর্থাৎ বর্ধমান দক্ষিণ, ভাতার ও মন্তেশ্বরে অবশ্য ২০১১ সাল থেকেই জিতে চলেছে তৃণমূল। অর্থাৎ এই মুহূর্তে বর্ধমান- দুর্গাপুর লোকসভা কেন্দ্রের ছটি বিধানসভা কেন্দ্রই রয়েছে তৃণমূলের দখলে। বামেরা চেষ্টার কসুর করছে না। সুকৃতি ঘোষাল জনসংযোগ বাড়ালেও জানেন যে বাম ভোট না ফিরলে লড়াই দ্বিমুখী হয়ে যাবে কারণ তৃণমূল কোমর বেঁধে নেমেছে এই কেন্দ্র পুনুরুদ্ধারে। তৃণমূলের কিছু অ্যাডভান্টেজও রয়েছে।আবার রয়েছে কাঁটাও ।
ভোটাররা গতবার লোকসভা ভোটে বিজেপিকে সুযোগ দিয়েছিলেন। এসএস আলুওয়ালিয়া ভোটে জিতেছিলেন ঠিকই তারপর তিনি কার্যত কর্পূরের মত উবে যান। অভিযোগ, কালেভদ্রে তাকে দেখা গিয়েছিল এই কেন্দ্রে। আলুওয়ালিয়ার নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তিতে ভরে গিয়েছিল বর্ধমান – দুর্গাপুর। হাওয়া যেদিকে বয়ে চলার কথা ছিল সেখানে দাঁড়িয়ে এই কেন্দ্রে দিলীপ ঘোষের মত ডাকাবুকো এবং কেউকেটা নেতা প্রার্থী না হ’লে বিজেপির এবার খড়কুটোর মত ভেসে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল। বিশেষ করে যেখানে তৃণমূলের প্রার্থী হয়েছেন ১৯৮৩ সালের বিশ্বকাপ জয়ী ভারতীয় দলের সদস্য কীর্তি আজাদ। রাজনীতির মঞ্চে তিনি ইউসুফ পাঠানের নবাগত নন। তাঁর তৃণমূলে যোগদান ভোটের আবহে নয়। তাঁর নাম মানুষ ক্রিকেট ও রাজনীতি উভয় পরিমণ্ডল থেকেই জানে। তাছাড়া, দুর্গাপুর শহরে অন্তত কিছু সংখ্যায় অবাঙালি মানুষ বাস করেন। অবাঙালি মানুষের কাছে তাঁর প্রভাব অন্যদের চেয়ে কম হওয়ার কথা নয়।
বর্ধমান-দুর্গাপুর লোকসভা কেন্দ্র থেকে সামান্য দূরেই আসানসোল। সেখানে বিজেপি প্রার্থী হয়েছেন গতবার দুর্গাপুরে বিজেপির জয়ী প্রার্থী এস এস আলুওয়ালিয়া। আসানসোল এবং দুর্গাপুর একই বৃত্তে টেনে তাই তৃণমূল ও কীর্তি আজাদের হয়ে শেষ বেলার প্রচারেও অভিষেক দিলীপ ঘোষের সঙ্গে আলুওয়ালিয়া এবং কয়লা মাফিয়া জয়দেব খাঁকে টেনে আনছেন। দিলীপ ঘোষ মেদিনীপুরে মানুষকে সময় দেননি এই অভিযোগ তুলে আনছে তৃণমূল যে ক্ষোভ আলুওয়ালিয়ার বিরুদ্ধে বর্ধমান- দুর্গাপুর জুড়ে। পাশাপাশি দিলীপ ঘোষের বিতর্কিত বক্তব্যও তৃণমূল তাদের প্রচারে প্রাধান্য দিচ্ছে। মা দুর্গার অপমান থেকে রগড়ে দেওয়ার প্রসঙ্গ উঠছে। উঠছে টাকা বিলির প্রসঙ্গ। সবচেয়ে এই লোকসভা কেন্দ্রের রয়েছে পরিবর্তনমুখী চরিত্র। কীর্তি আজাদ তাই আত্মবিশ্বাসী। তাঁর আত্মপ্রত্যয় যেন ঝরে ঝরে পড়ছে।ভোটাররা কি কীর্তি আজাদকে সুযোগ দেবেন?
কীর্তি আজাদের সমস্যা যে তিনি প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে পেয়েছেন দিলীপ ঘোষকে। যার বিরুদ্ধে বলার অনেক কিছু বিতর্কিত কথা থাকলেও তিনি এক ও অদ্বিতীয় দিলীপ ঘোষ। তিনি ঘাঘু ও পোড় খাওয়া রাজনীতিক। তিনি এবার তৃণমূলকে তৃণমূলের অস্ত্রেই ঘায়েল করতে চাইছেন। আলুওয়ালিয়ার বিরুদ্ধে ক্ষোভকে তৃণমূলের বিরুদ্ধে সুকৌশলী ভাবে এনক্যাশ করতে চাইছেন ভোটের বাক্সে। তিনি বারবার বলছেন, কীর্তি আজাদ বহিরাগত। মোদি বা অন্য বিজেপি নেতৃত্ব বহিরাগত কিনা সেই প্রসঙ্গ সুকৌশলে পাশ কাটিয়ে তৃণমূল প্রার্থীকে বিঁধে চলেছেন। আর তাঁর অস্ত্র তৃণমূলের গোষ্ঠিকোন্দল। তৃণমূলের কাঁটা তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব যা বারবার প্রকট হয়েছে। এই প্রসঙ্গে কীর্তি আজাদের ক্যারিকেচার করতেও ছাড়ছেন না দিলীপ ঘোষ। “নো টেনশন, অনলি অ্যাটেনশন স্লোগান ” নিয়ে যুদ্ধজয়ের প্রস্তুতি সেরেছেন দিলীপ ঘোষ।
২০১৯ সালের অল্পের জন্য লক্ষ্যভ্রষ্ট তৃণমূল এই কেন্দ্র জিততে যতই চেষ্টা করুক, যতই বিভিন্ন বিধানসভা কেন্দ্রে তাদের লিড থাকুক, পরিবর্তন মুখী বর্ধমান-দুর্গাপুর লোকসভা কেন্দ্র ঘিরে তৃণমূলের আশা যতই প্রবল থাকুক, ২০২৪ সালে তৃণমূলের জেতা মোটেই সহজ নয়। কারণ তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী একমেবদ্বিতীয়ম দিলীপ ঘোষ। তবুও অঙ্ক বলছে, জিততেই পারে তৃণমূল।এই প্রবল বাধা টপকে কীর্তি আজাদ ঘাসফুলের হয়ে কীর্তি স্থাপন করেন কিনা সেদিকে নজর বঙ্গ ছাড়িয়ে আসমুদ্র হিমাচল ভারতের।
More Stories
ডিগ্রি নেই, অথচ চিকিৎসা করছেন! আর জি কর আন্দোলনের মুখ আসফাকুল্লাকে নোটিস কাউন্সিলের
মেদিনীপুরে ‘বিষ’ স্যালাইন কাণ্ডে এবার সন্তানহারা অসুস্থ প্রসূতি!
এবার স্বাস্থ্যদপ্তর ডাক্তারদের প্রাইভেট প্র্যাকটিসের আবেদনের সময়সীমা বেঁধে দিল