Home » অভিশপ্ত ভানগড় দুর্গের ইতিহাস ও অলৌকিক কাহিনী

অভিশপ্ত ভানগড় দুর্গের ইতিহাস ও অলৌকিক কাহিনী

পুরন্দর চক্রবর্তী, সময় কলকাতা, ২৮ জুন : আতঙ্কের নাম ভানগড় দুর্গ । রাতে ভানগড় দুর্গের ধারেকাছে কেউ যেতে চায় না।গভীর রাতে অশরীরী আত্মারা জেগে ওঠে এখানে। অলৌকিক কার্যকলাপ চলে রাতভর। কখনও কোনও শিশু, কখনও কোনও সম্ভ্রান্ত রমণী, কখনও বিদেহী সাধু রাতে ঘুরে বেড়ায়। হাড়হিম হয়ে যায় অশরীরীদের খিলখিল হাসি ও ভয়ঙ্কর আর্তনাদের শব্দে।

অভিশপ্ত ইতিহাস ভানগড়ের, বিভীষিকার অন্য নাম যেন ভানগড় দুর্গ । হাওয়া নাকি কেঁদে ফেরে রাতের ভারি হয়ে ওঠা বাতাসে।  রাতে এখানে গেলে প্রাণে বেঁচে ফেরা নাকি দায়। বাস্তবে কী হয় এখানে? কেন এত দুর্নাম ভানগড় দুর্গের?

 

ভানগড় রাজ্য ও দুর্গের কথা বলতে হলে রাণী রত্নাবতীর কথা দিয়েই শুরু করতে হয়। বলতে হয় জনশ্রুতি আর লোককথা। সপ্তদশ শতকে অপূর্ব সুন্দরী ছিলেন রাজস্থানের রাণী রত্নাবতী। ঐতিহাসিকদের মধ্যে সাধারণভাবে যে প্রচলিত ব্যাখ্যা অনুযায়ী, রানী রত্নাবতী ছিলেন ভানগড় দুর্গের প্রতিষ্ঠাতা মাধো সিংয়ের পত্নী। তবে ঐতিহাসিকদের কেউ কেউ বিশ্বাস করেন, রত্নাবতী ছিলেন ভানগড়ের রাজকুমারী। রাণী বা রাজকুমারী যেই হন না কেন রত্নাবতী, তাঁর রূপের খ্যাতি ছিল জগৎজোড়া।তাঁর দিকে তাকালে চোখ ফেরানো যেত না।রাজস্থানের ভানগড়ের রাণী রত্নাবতীর রূপের কথা তাঁর রাজ্য ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল দিকে দিকে। আর তাঁকে নিয়েই শুরু অতৃপ্ত প্রেম, হত্যা ও অভিশাপের কথামালা। কী সেই কাহিনী?

ভানগড়ে ছিল এক তান্ত্রিক জাদুকর। তার নাম সিংঘিয়া। কালা জাদু জানত তান্ত্রিক। রাণীর রূপে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে পাওয়ার জন্য পাগল হয়ে ওঠে সে । রাণীকে মরিয়া হয়ে চাইতে শুরু করে সে, যদিও জানত রাণীকে পাওয়া তার পক্ষে প্রায় অসম্ভব। তবুও তার মনে রানীর জন্য কামনা বাসনা এত প্রবল হয়ে ওঠে যে সে কালাজাদুর সাহায্যে রাণীকে বশ করার জন্য মনস্থির করে। রাণীর এক পরিচারিকা কে মন্ত্রমুগ্ধকারী তেল কিনতে দেখে রাণীকে বশীকরণের জন্য সেই তেলে জাদুবিদ্যার প্রয়োগ করে। রাণী সেই মায়াভরা তরল স্পর্শ করলেই রাণী তান্ত্রিকের কাছে নিজেকে সমর্পণ করবে এমনভাবেই  জাদুর কৌশল খাটায় সে । রানী ষড়যন্ত্রের কথা জেনে যান ।তাছাড়া,রাণীও কালাজাদুর কৌশল জানতেন।তিনি সিংঘিয়াকে হত্যার ছক কষেন। এক বিশাল প্রস্তরখন্ডের উপরে সেই তেল ঢেলে দেওয়া হয় । সেই পাথর গড়িয়ে পড়ে। সেই পাথরে চূর্ণ হয়ে নিহত হয় তান্ত্রিক। মৃত্যুর আগে সেই তান্ত্রিক অভিশাপ দিয়ে যায়, মৃত্যু নগরী হয়ে উঠবে ভানগড়। ধ্বংস হয়ে যাবে নগরী। এরকম একাধিক জনশ্রুতি, গল্প ও উপকথা মোটামুটি ভানগড়ের রাণী ও তান্ত্রিক সাধুকে নিয়ে প্রচলিত থাকলেও গল্পের শেষটুকু একইরকম। মৃত্যুর আগে তান্ত্রিকের অভিশাপ পড়েছিল ভানগড়ের উপরে।তিনি অভিশাপ দিয়েছিলেন বাঁচবে না ভানগড়ের কেউ। ধ্বংস হয়ে যাবে ভানগড়।পরবর্তীতে আজবগড় এবং ভানগড়ের মধ্যে যুদ্ধের সময়, রানী রত্নাবতী সহ ভানগড়ের রাজার বাহিনী নিহত হয়।আর এর কিছুদিনের মধ্যেই প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও অতিমারির কারণে ধ্বংস হয়ে যায় ভানগড়। অতঃপর অভিশপ্ত ভানগড় হয়ে ওঠে হন্টেড বা ভৌতিক স্থান । যদিও এই অভিশাপের আর একটি প্রচলিত কাহিনীও রয়েছে যেখানে অভিশাপ নেমে আসার পৌরাণিক কার্য-কারণ রয়েছে।

পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে, গুরু বালু নাথ, একজন পরাক্রমশালী তপস্বী ভানগড় দুর্গ এলাকায় বাস করতেন।মাধো সিং দুর্গ নির্মাণের আগে তার সম্মতি নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং তা দেওয়াও হয়, কিন্তু একটি শর্তে। তপস্বী একটি বিধিনিষেধ জারি করেছিলেন যে তার বাড়ি যেন কখনই দুর্গের ছায়ায় ঢাকা না পড়ে একটি ভয়ানক বিপর্যয় ঘটবে।দুর্ভাগ্যবশত, মাধো সিং-এর উচ্চাভিলাষী উত্তরসূরি সতর্কতা উপেক্ষা করে ভানগড় কা কিলার চারপাশে উঁচু প্রাচীর নির্মাণ করেন। জনশ্রুতি, তপস্বীর বাসগৃহ ছায়া দিয়ে ঢেকে যায় যার ফলে, সমগ্র ভানগড় অভিশপ্ত হয়েছিল। অতঃপর অভিশপ্ত স্থানে ভৌতিক এবং যুক্তি -বুদ্ধিতে ব্যাখ্যা মেলে না যার এরকম ঘটনা একের পর এক ঘটতে থাকে।

এখনও ভানগড় দুর্গে রাতে কাউকেই থাকতে দেওয়া হয় না। রাতে নির্জন, নিঃশব্দ হয়ে পড়ে থাকে ভগ্নপ্রায় দুর্গ। জেগে থাকে অশরীরীরা, এমনটাই কিংবদন্তী।ভানগড় দুর্গকে ভারতের অন্যতম ভৌতিক স্থান বলার পাশাপাশি জানতে হবে  ভৌতিক কাণ্ড ও ঘটনাবলী। তবে তা জানার আগে জানা দরকার ভানগড় দুর্গের প্রকৃত ইতিহাস ও ভূগোল ।

ভানগড়ের ইতিহাস চারশো বছরে পুরোনো। ঐতিহাসিকদের বিভিন্ন মত সমর্থন করে বলা যায়, ভানগড় শহরটি ১৫৭৩ সালে মহারাজা ভগবন্ত দাস নামে আম্বরের কচ্ছওয়াহা শাসকের শাসনকালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তাঁর দুই পুত্রের মধ্যে বড় ছেলে মান সিং ছিলেন মুঘল সম্রাট আকবরের বিশ্বস্ত সেনাপতি এবং সম্রাটের নবরত্নদের মধ্যে একজন। ছোট ছেলে মাধো সিং যিনি ভানগড় দুর্গ তৈরি করেছিলেন। ধ্বংস হওয়ার আগে ভানগড় দুর্গের চারপাশের জনবসতি ধরে প্রায় দশ হাজার মানুষের বসবাস ছিল বলে উল্লেখ মেলে। ভৌগোলিক ভাবে, রাজস্থানের জয়পুর থেকে মাত্র ৮৩ কিলোমিটার দূরত্ব। আলোয়ার থেকে একশো তিরিশ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ভানগড়। বাস বা ক্যাব রয়েছে যাওয়ার জন্য। সরিস্কা অভয়ারণ্য পঞ্চাশ কিলোমিটারের মধ্যে। দেখার আরও অনেক কিছুই আছে কাছেপিঠে।কাছেই রয়েছে সোমেশ্বর মন্দির।প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে গবেষণার জায়গা ভানগড়। আধিভৌতিক -আধিদৈবিক স্থানে অনেক ঐতিহাসিক নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে। এশিয়ার মধ্যে অন্যতম হন্টেড বা ভৌতিক স্থান হলেও এখানে ভারতীয় দর্শকদের দর্শনের সময় সীমিত। আর বিদেশী পর্যটকদের অবাধ প্রবেশাধিকার-ই নেই।  শোনা যায়,এখানে একাধিক বিদেশি পর্যটক হারিয়ে গিয়েছেন। তাদের হারিয়ে যাওয়ার পরে সরকারি ভাবে চরম সিদ্ধান্ত নিয়ে বিদেশী পর্যটকদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়। সাধারণভাবে, বর্তমানে অত্যন্ত দর্শনীয় দুর্গ না হলেও ভানগড় দুর্গের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা অলৌকিক লোককথা ভেঙে পড়া ভানগড় দুর্গকে আকর্ষণীয় করে তুলেছে।

ভানগড় দুর্গ একেবারেই অক্ষত নেই, কার্যত কোনও পাঁচিল নেই অবশিষ্ট। ছাদও প্রায় নেই। স্থানীয় মানুষের বক্তব্য, দুর্গের অবশিষ্ট ভগ্নাংশ ভেঙে পড়ে বহু সময় বহু মানুষের প্রাণ গিয়েছে।অভিশপ্ত ভানগড়ে কী কী ভৌতিক ঘটনার কথা শুনতে পাওয়া গিয়েছে?

ভানগড়ের ভৌতিক ঘটনামালা

অজস্র কাহিনী, অসংখ্য কাহিনী, কিংবদন্তি ঘিরে রয়েছে ভানগড় ঘিরে। স্থানীয় মানুষরাই কতবার এখানের ভৌতিক বিষয় সঠিকভাবে জানতে চেয়েছে, ভেদ করতে চেয়েছে রহস্য । জানতে চেয়েই যেন নেমে এসেছে অভিশাপ। বারবার ঘটেছে বিপদ। কিছুদিন আগে অবশেষে তিন সাহসী এবং কুসংস্কার না থাকা মানুষ ভানগড়ের প্রচলিত ভীতি কাটাতে রাত দুর্গে যাপনের প্রতিজ্ঞা করে।  তারা দুর্গ এলাকায় রাত কাটানোর  প্রস্তুতি নিয়ে যায়।  কিসের টানে জানা যায় না, তবুও রাতে আচমকাই এদের একজন অন্ধকারে কুঁয়োর মধ্যে পড়ে যায়। বাকি দুজন তাকে বহু কষ্টে কুঁয়ো থেকে তুলে একটি গাড়িতে করে হাসপাতালের দিকে রওয়না হয়। পথেই গাড়িটি ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনায় পড়ে। তিনজনই মারা যায়। এছাড়াও সাম্প্রতিক সময়ে, স্থানীয়দের দাবি যে তরুণদের একটি দল ভানগড় দুর্গে বেড়াতে যায়। দরজা নেই অথচ লোহার গ্রিল করা জানালা এমন আশ্চর্য এক আলো আঁধারে ঢাকা ঘর নজরে আসে ।ঘরে একটি শিশুকে স্পষ্টভাবে তারা দেখতে পায় বলে দাবি করে। অনেকে আবার বলে, রাণী ও তান্ত্রিকের বেশে অশরীরীকে ঘুরে বেড়াতে দেখতে পাওয়া গিয়েছে ।এরকম ভৌতিক, অলৌকিক কাহিনীকে সত্যি বলে মেনে নিয়েছে ভানগড়ের মানুষ।

ভানগড় দুর্গের বেশ কয়েকটি জায়গায় ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগ বা আর্কিওলজিক্যাল সোসাইটি অফ ইন্ডিয়ার নিষেধাজ্ঞা ও সতর্কতার কথা লেখা রয়েছে । বলা আছে, অন্ধকারের পরে বা সূর্যোদয়ের আগে এই দুর্গ এলাকায় থাকা যাবে না। কথিত আছে, স্থানীয়দের সবাই বলেন রাতে অশরীরীরা জেগে ওঠে এখানে। সবাই বলে, ভানগড়ের হাওয়া যেন অস্বস্তিকর ভাবে ভারি হয়ে ওঠে। যারা বেঁচে ফিরেছে ভানগড় থেকে তাদের অভিজ্ঞতা নাকি করুণ ও আতঙ্কের। রাতে, দুর্গের দেয়ালের ভিতরে অদ্ভুত আওয়াজ শোনা যায়, শোনা যায় কান্না, গোঙ্গানি বা ভয় ধরানো খিল-খিল করে হাসির শব্দ।গুঞ্জন আছে যে, দুর্গের ভিতরে বিদেহী ও অশরীরীরা একা বা দল বেঁধে ঘোরাফেরা করে, যার ফলে সেখানে অলৌকিক কার্যকলাপ ঘটতে থাকে।এরকম ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছে  বহু মানুষ বা তাদের পূর্বপুরুষদের কাছে শুনে এসেছেন বহু মানুষ, বলেন এলাকাবাসী। এলাকাবাসী এও বলে, কত মানুষ এখানে হারিয়ে গিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই।  বহু মানুষ রাতের অন্ধকারে হাওয়ার মত, কর্পূরের মত উবে গিয়েছে তারও লেখাজোখা নেই। কোথায় তারা হারিয়ে গিয়েছে তার কোনও হদিশ মেলে নি। স্থানীয়রা আজও শিউরে উঠে বলেন, যারা অতি সাহসী হয়ে রাতে ভানগড় দুর্গে ঢুকেছে তাদের অধিকাংশ মানুষই  চিরতরে হারিয়ে গিয়েছে । যারা ফিরে এসেছে তাদের অনেকেই বলতে পারে না রাতে তাদের সঙ্গে কি হয়েছে, কিভাবে রাত কেটেছে। কেউ কেউ পালিয়ে এসেও দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে। কেউ মারা গিয়েছে কেউ জখম হয়েছে। কিভাবে হল – জিজ্ঞেস করা হলে বোবা চাউনিতে তারা তাকিয়ে থেকেছে । কোনও উত্তর মেলে নি, যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা নেই । কোনও ব্যাখ্যা হয় না কেন যে এরকম অলৌকিক কাণ্ড ঘটে চলে ভানগড়ে ।  হাওয়া কেঁদে ফেরে ভানগড়ের অভিশপ্ত দুর্গে। ইতিহাসও যেন অভিশপ্ত ভানগড়ে।।

About Post Author