Home » বাগদায় রেকর্ড গড়তে পারবেন মধুপর্ণা ?

বাগদায় রেকর্ড গড়তে পারবেন মধুপর্ণা ?

পুরন্দর চক্রবর্তী,সময় কলকাতা, ৯ জুলাই : অরুণ বর্মা, উমেদ সিং – ইতিহাস বই ঘাঁটলে এঁদের নাম উঠে আসবে ভারতের কনিষ্ঠতম বিধায়ক হিসেবে। সম্প্রতি এই ইতিহাসে নিজের নাম সংযোজন করেছেন উড়িষ্যার উপাসনা মহাপাত্র।বঙ্গের ইতিহাসে সুব্রত মুখোপাধ্যায় ছিলেন সবচেয়ে কনিষ্ঠতম বিধায়ক। কিন্তু এঁদের সবার ইতিহাস ও রেকর্ড ভাঙতে পারেন বাগদা বিধানসভা উপনির্বাচনে তৃণমূল প্রার্থী মধুপর্ণা ঠাকুর। যদি তিনি জেতেন তবে ২৫ বছর ১ মাস বয়সী মধুপর্ণা ঠাকুর এক আশ্চর্য রেকর্ড গড়বেন। প্রশ্ন হচ্ছে, বিজেপির হাত থেকে তিনি কি বাগদার আসন ছিনিয়ে আনতে পারবেন?

আরও পড়ুন : সাধন পত্নী সুপ্তি নাকি কল্যাণ? জিতবেন কে?

বাগদা বিধানসভা কেন্দ্রে বরাবরই লড়াইটা ছিল ফরওয়ার্ড ব্লক আর কংগ্রেসের মধ্যে। ১৯৯৮ সালে তৃণমূল কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরে বাগদার মানচিত্রে তৃণমূল ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠা পেতে থাকে। ২০০১ সালে বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূলের দুলাল বর ফরওয়ার্ড ব্লকের কমলাক্ষী বিশ্বাসের কাছে হেরে গেলেও ২০০৬ সালে পাশা উল্টে যায়। কমলক্ষ্মী বিশ্বাসকে হারতে হয় দুলাল বরের কাছে। ২০১১ সালে আমলা উপেন্দ্রনাথ বিশ্বাস তৃণমূলকে আবার জয়ী করেন। দলত্যাগ করে কংগ্রেসে যাওয়া প্রাক্তন তৃণমূল বিধায়ক দুলাল বর ২০১৬ সালে তৃণমূলের উপেন্দ্রনাথ বিশ্বাসকে আবার হারিয়ে দেন। ২০১৯ সালে লোকসভা ভোটে বনগাঁ লোকসভা কেন্দ্র থেকে বিজেপির টিকিটে দাঁড়িয়ে যেতেন মতুয়া মহা সংঘের সংঘাধিপতি ও ঠাকুরনগর ঠাকুরবাড়ির মঞ্জুল কৃষ্ণ ঠাকুরের পুত্র শান্তনু ঠাকুর। বাগদা বিধানসভা কেন্দ্র বনগাঁ লোকসভা কেন্দ্রের অন্যতম বিধানসভা ক্ষেত্র এবং মতুয়া অধ্যুষিত। বিজেপি বনগাঁ লোকসভা দখল করার পরেই বাগদা কার্যত চলে যায় বিজেপির দখলে। ২০১৯ ও ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে এবং ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বাগদা বিধানসভা কেন্দ্রে বিজেপির জয় জয়কার দেখা গিয়েছে। ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে বাগদার প্রাক্তন বিধায়ক বিশ্বজিৎ দাস বিজেপি ছেড়ে এসে তৃণমূলের টিকিটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। অন্য দলে গিয়ে লোকসভা ভোটে হেরে যাওয়ায় তাঁর বিধায়ক পদ খারিজ হয়। লোকসভা ভোটের পর পরই তাই বাগদার মানুষকে আবার বিধানসভা ভোট দিতে হচ্ছে। ১০ তারিখ বিধানসভা ভোটে তৃণমূলের প্রার্থী মতুয়া ঠাকুর বাড়ির রাজ্যসভার তৃণমূল সাংসদ মমতা ঠাকুরের কন্যা মধুপর্ণা ঠাকুর। তাঁর প্রধান প্রতিপক্ষ বিজেপির বিনয় কুমার বিশ্বাস।যে দুই দলের বাগদায় দীর্ঘদিনের আধিপত্য ছিল সেই দুই দলও ভোটের ময়দানে আছে। ফরওয়ার্ড ব্লকের হয়ে লড়ছেন গৌরাদিত্য বিশ্বাস। কংগ্রেসের হয়ে লড়ছেন অশোক কুমার হালদার। অর্থাৎ এখানে কংগ্রেস বাম সমঝোতা হয় নি এবং এই দুদলের সম্ভাবনা যে কার্যত শূন্য তা বললে অতিশয়োক্তি হয় না। লড়াই প্রধানত তৃণমূল ও বিজেপির মধ্যে সীমাবদ্ধ এনিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। মধুপর্ণা ও বিনয় কার পাল্লা ভারী দেখে নেওয়া যাক।

কপিল কৃষ্ণ ঠাকুরের ছোট মেয়ে মধুপর্ণা ঠাকুর গুরুচাঁদ- হরিচাঁদ পরিবারের সদস্যা হলেও শান্তনু ঠাকুরের সম্পর্কিত তুতো বোন ও তাঁর মার সঙ্গে শান্তনু বা তাঁর ভাই সুব্রতদের কার্যত মুখ দেখাদেখি নেই। মধুপর্ণার মা মমতা ঠাকুর যতই ঠাকুরনগরের ঠাকুর পরিবারের সঙ্গে বিবাহ সূত্রে যুক্ত হন, তাঁর সঙ্গে অহি-নকুল সম্পর্ক মঞ্জুল কৃষ্ণ এবং তার দুই পুত্রের। অন্যদিকে বিজেপি প্রার্থী বিনয় বিশ্বাসের ঠাকুরনগরের ঠাকুর বাড়ির সঙ্গে আত্মীয়তা বা রক্তের সম্পর্কে যোগসূত্র না থাকলেও তিনি মতুয়া সম্প্রদায় ভুক্ত এবং বিনয়ের উপরে শান্তনুদের সমর্থন থাকছে। এখন দুটি বিষয় এবারের ভোটে প্রধান বিবেচ্য হয়ে উঠেছে। প্রথমত, মতুয়া ভোট কোন দিকে যাবে। দ্বিতীয়ত, তৃণমূলের দাবার চাল কি হবে কারণ বনগাঁ লোকসভায় বিজেপির দুর্গে আঘাত হানতে হলে মধুপর্ণা দাবার বড় গুটি হয়ে উঠতে পারে। তার আগে সাম্প্রতিক অঙ্কে চোখ রাখা যাক। উল্লেখ্য,বর্তমান ইতিহাসের মতই অংক আবার তৃণমূলের পক্ষে কথা বলছে না। কারণ বিশ্বজিৎ দাস বিজেপির টিকিটে ২০২১ সালে এই কেন্দ্রে জয়ী হয়েছিলেন প্রায় দশ হাজার ভোটে। ২০২৪ সালে তৃণমূলের টিকিটে তিনি শান্তনু ঠাকুরের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও বিজেপির ব্যবধান দ্বিগুণ হয়েছে। ৭৫ হাজার ভোটে জয়ী শান্তনু ঠাকুর বাগদা বিধানসভা কেন্দ্র থেকে কুড়ি হাজারের বেশি ভোটে লিভ নিয়ে নেন। অর্থাৎ লোকসভা ভোটের নিরিখে বাগদায় বেশ পিছিয়ে তৃণমূল তথা তরুণী মধুপর্ণা। এবং মতুয়া জনগোষ্ঠীর বিরাট অংশের ভোটব্যাঙ্ক বনগাঁ -বাগদা থেকে রানাঘাট পর্যন্ত যে প্রায় অক্ষুন্ন আছে তা প্রমাণ করেছেন শান্তনু – জগন্নাথ। সিএএ ইস্যু বিজেপির লাভ লোকসানের পথে অন্তরায় হয়ে উঠতে পারেনি তা সম্প্রতি হয়ে যাওয়া লোকসভা ভোটে মালুম হয়েছে। আর তাই এখানেই আসছে তৃণমূলের চাল বা কৌশলের কথা।

কৌশল ছাড়া জয় সম্ভব নয় মানছে তৃণমূল শিবির। তবে তারা আত্মবিশ্বাসী। মতুয়া ভোট ফিরিয়ে আনতে দায়িত্ব হয়েছে মধুপর্ণা ও তার মা মমতা ঠাকুরকে। মতুয়াদের বিভিন্ন সঙ্ঘের গোসাঁই বা প্রধানদের সঙ্গে আলাদাভাবে কথা বলতে বলা হয়েছে তাঁদের। এরমধ্যেও তৃণমূলের কৌশল নিয়ে কটাক্ষ ও অভিযোগ করেছে বিজেপি । কেন্দ্রীয় বাহিনী থাকলে কি হবে, শুভেন্দু অধিকারী ইতিমধ্যেই ভোটলুঠের তত্ত্ব খাড়া করে তাঁদের আশঙ্কার কথা জানিয়ে রেখেছেন। শুভেন্দু বলছেন, ভোট লুঠ করে বাগদায় জিততে চায় তৃণমূল।

একদা জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক দলের তরফে ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে তৃণমূলের যোগাযোগের বিষয় দেখাশোনা করতেন। তিনি কারাবাসে। তাঁর অবর্তমানে এবারের ভোটে দায়িত্ব বর্তেছে ব্যারাকপুরের সাংসদ পার্থ ভৌমিক, মন্ত্রী রথীন ঘোষ,তৃণমূলের বিধানসভার চিফ হুইপ নির্মল ঘোষের উপরে। এছাড়াও নারায়ণ গোস্বামী, সুজিত বসুদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। উত্তর ২৪ পরগনার নেতারা এককাট্টা হয়ে যেন যুদ্ধে নেমেছেন মধুপর্ণার হয়ে।যেনতেন প্রকারেণ জয় চাইছে তৃণমূল। মুশকিল হচ্ছে মতুয়া সংঘাধিপতি শান্তনু যে লোকসভা কেন্দ্রের সাংসদ সেই কেন্দ্রের একটি ক্ষেত্রে জয় ছিনিয়ে আনা সহজ নয়। বিশেষত সবে যে বিধানসভা কেন্দ্রে কুড়ি হাজারের বেশি ভোটে লিড পেয়েছে বিজেপি সেখানে মধুপর্ণার জয় সহজ হবে না। তবুও তিনি ঠাকুর পরিবারের কন্যা এবং তিনি তরুণ প্রজন্মের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে পারেন।সঙ্গে থাকছে লক্ষীর ভান্ডার সহ একগুচ্ছ প্রকল্প এবং পঞ্চায়েত ভিত্তিক উন্নয়নের কথা। সর্বোপরি, সাম্প্রতিক লোকসভা ভোটে বাগদায় পিছিয়ে থাকলে কি হবে, সারা রাজ্যে তৃণমূল যথেষ্ট ভালো ফল করেছে এবং দক্ষিণবঙ্গে তৃণমূলের ঝড় দেখা গিয়েছে। তার প্রভাব বাগদার উপনির্বাচনের দেখা গেলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। আর এই সব সমীকরণের যোগফলে মধুপর্ণা জয়ী হয়ে কনিষ্ঠতম বিধায়ক হওয়ার নতুন নজির গড়বে বলেই দৃঢ়বিশ্বাস তৃণমূল নেতা -কর্মী – সমর্থকদের।।

আরও পড়ুন মুকুটমণি কি বিধায়কের মুকুট ফিরে পাবেন?

About Post Author