Home » পুলিশি অতিতৎপরতায় সংকটনাশিনী কালীপুজোয় কি সংকটে বারাসাতের পুজো সংস্কৃতি ও জনজীবন?

পুলিশি অতিতৎপরতায় সংকটনাশিনী কালীপুজোয় কি সংকটে বারাসাতের পুজো সংস্কৃতি ও জনজীবন?

সময় কলকাতা ডেস্ক, ২১ অক্টোবর : বিপদতারিণী মা কালী দেবী দুর্গার ১০৮টি রূপের একটি, যিনি ভক্তদের সকল বিপদ থেকে রক্ষা করেন। তাঁকে সঙ্কটনাশিনীও বলা হয়। তা বারাসাত জুড়ে যখন উৎসবের মরশুম তখন বিপদতারিণী মা কালীর বন্দনা তথা শ্যামা বন্দনা করতে গিয়ে নাজেহাল বারাসাত বাসী।  বারাসাতের কালীপুজো তথা  বিপত্তারিণী ও সংকটনাশিনীর বন্দনা করতে গিয়ে বহু প্রকার বিপদ ও সংকট দেখা দিচ্ছে বলেই অভিযোগ উঠছে।  কেউ কেউ একধাপ এগিয়ে বলছেন, করোনা কালে এত ঝক্কি সামলাতে হয় নি যা এবারের পুলিশ প্রশাসনের অতিতৎপরতায় সামলাতে হচ্ছে। বলা বাহুল্য বারাসাতের সাধারণ নাগরিকের বক্তব্য, পুলিশ নিজেদের ঝুঁকি কমাতে গিয়ে এমন কিছু পন্থা নিয়েছে যা সাধারণ মানুষ ও পুজো আয়োজক উভয় পক্ষকেই বিপাকে ফেলছে। সময় কলকাতা ২০২৫ সালের বারাসাতের কালী পুজোয় আদৌ কী সত্যি বিপর্যস্ত কিনা তা বোঝার চেষ্টা করে দফায় দফায় আয়োজক ও সমাজের মনন শীল বর্গ ও সাধারণ মানুষদের সঙ্গে কথা বলেছে এবং বুঝতে চেষ্টা করেছে সমস্যা সত্যি থেকে থাকলে কারণ কী এবং সমাধানের পথ।

বারাসাতের কালীপুজো এক মহোৎসব বলাই বাহুল্য। দশ বারোটি এমন মেগাবাজেটের পুজো রয়েছে যেখানে অন্তত চার দিন ধরে লক্ষ লক্ষ মানুষের সমাগম ঘটে।   বিগত দিনে উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলা পুলিশ ও আজকে যা বিভক্ত হয়ে বারাসাত জেলা পুলিশ প্রতিবার প্রতিবাদ বারাসাতের পুজোকে বিশৃঙ্খলার হাত থেকে রক্ষা করতে এক সুচিন্তিত নীল নকশা বানায়। এই নীল নকশা বা ব্লু প্রিন্ট দূর দূর থেকে আসা কালীপুজোর দর্শণার্থী,সাধারণ মানুষ, বারাসাতের নাগরিক এবং জরুরি এবং আপৎকালীন পরিষেবা কে সুচারু এবং কার্যকরী রাখতে সক্ষম হয়। পাশাপাশি পুজোর আয়োজকরা নিজেদের পুজো নির্ঝরভাবে সম্পন্ন করতে সক্ষম হয় এবং পুজো উপলক্ষ্যে ব্যবসা থেকে ব্যবসা থেকে দুটো পয়সার মুখ দেখতে পায়। যে দর্শনার্থীরা পূজোয় মন্ডপে আসতে পারেন না সংবাদ মাধ্যম ও তাদের ছবি রাজ্য দেশ ও বিদেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়। পুলিশ প্রশাসনের তৎপরতায় কালীপুজোর বারাসাত চলতে থাকে তেল দেওয়া মেশিনের মত। এবার সেক্ষেত্রে কতটা সফল হয়েছে পুলিশ প্রশাসনের নেওয়া উদ্যোগ? অভিযোগ উঠছে পুলিশের ” অতি তৎপরতায়” বারাসাতের কালী পুজোয় জেরবার মানুষ। কালীপুজো সুষ্ঠুভাবে করতে গিয়ে যে পদক্ষেপগুলি পুলিশ নিয়েছে সেগুলি বুমেরাং হয়ে সাধারণ মানুষকে পিষে ফেলছে অভিযোগ এমনটাই। তারচেয়ে বড় অভিযোগ যে, প্রশাসনিক অতি তৎপরতায় বারাসাত ও বাঙালির কালীপুজোর ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিতে কুঠারাঘাত করেছে পুলিশ প্রশাসন। সত্যি কি তাই?

যানজট, বিশৃঙ্খলা অব্যবস্থার চূড়ান্ত রূপ বারাসাতের কালীপুজোয়। দর্শনার্থীদের বক্তব্য সেটাই। শ্যামা পুজো উপলক্ষে বিশেষ সাইট খোলা হলেও তা মানুষের কাছে পৌছায় নি। মানুষ প্রযুক্তি মেনে পুজো দেখবে নাকি কোনো রকমে পুজো দেখে কোনরকমে বাড়ি ফিরবে সেটাই এখন লাখ টাকার প্রশ্ন।

বারাসাতের কালীপুজো ঘিরে সবচেয়ে বড় অভিযোগ আসছে সমাজের মননশীল গোষ্ঠীর কাছ থেকে। সবচেয়ে বড় কথা, মানুষের জীবন দায়ী পরিষেবা যারা দেন সেই চিকিৎসকরা বলছেন,রোগীরা তাঁদের কাছে আসতে পারছেন না। চিকিৎসা ও করা যাচ্ছে না জরুরি কালীন ভিত্তিতে। এ নিয়ে চিকিৎসকদের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ফেসবুক সাইটে ও দেখা যাচ্ছে। ফুড ডেলিভারি র লোকজন বিভিন্ন এলাকায় ঢুকতে পারছেন না। বিভিন্ন পরিষেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রচুর অসুবিধা সামনে পড়তে হচ্ছে বিভিন্ন ক্ষেত্রের মানুষ কে। এই প্রথমবার বারাসাতে মানুষ ভাবতে শুরু করেছে কালীপুজো আশীর্বাদ না অভিশাপ। সৌজন্যে বারাসাত জেলা পুলিশের অতিতৎপরতা।

বারাসাতের সুদীর্ঘ কালীপুজোর ইতিহাসে এমনটা হয় নি যে, কালীপুজো আয়োজন কে কেন্দ্র করে শাসক দল ও প্রধান বিরোধী দলের নেতারা একই মেরুত অবস্থান করছেন। তাদের ক্ষোভ পুলিশ প্রশাসনের বিরুদ্ধে। একজন আয়োজক আরও এক পা এগিয়ে বললেন, পুজো আয়োজন করতে গিয়ে আমরা ট্রাক বাস থামিয়ে চাঁদা তুলি না, জোর জুলুম করি না। পাইওনিয়ার পার্কের পুজোর মুখ্য উদ্যোক্তা ও তৃণমূল নেতা দেবব্রত পাল জানিয়েছেন, তিনি উদ্যোগ না নিলে একটি দোকানও বসতে দিত না পুলিশ যা জোর করে বন্ধ করে দিয়েছিল তারা। তিনি এও জানিয়েছেন দোকান বা মেলা আয়োজন করেই পুজোর খরচ উঠে আসে তাও করতে দিতে চায়না পুলিশ।  ছাত্রদল পূজোর অন্যতম উদ্যোক্তা বিজেপি নেতা প্রতীপ চ্যাটার্জী জানিয়েছেন, পুলিশ পুজো নির্বিঘ্নে করতে গিয়ে খেটে খাওয়া মানুষদের পেটে পদাঘাত করছে।

আর এ প্রশ্নে জড়িয়ে গেছে পুজোর সময় বিভিন্ন স্টলের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের স্বার্থ। পুলিশ জোর করে অনেক দোকান বন্ধ করে দেওয়ায় পুজোর সময় অনেক টাকা লগ্নি করে দুটো লাভের পয়সার মুখ দেখতে গিয়ে মাথায় হাত ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের।

বারাসাতের সাধারণ নাগরিকরা ও ক্ষুব্ধ।তারা বাড়ি থেকে বেরোতে পারছেন না, বাজার ঘাট করতে পারছেন না। ওষুধের দোকানে যেতে পারছেন না, হাসপাতালে যাওয়া প্রয়োজন হলেও সেখানেও যাওয়া অসম্ভব হয়ে উঠেছে পুলিশি কড়াকড়ি এবং অতি তৎপরতায়। পুলিশ যাতায়াতের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা দীর্ঘ সময় ধরে ছক কষে রাখে যা এবারের পুজোয় অনুপস্থিত। করোনা কালে বা অন্য পুজো গুলির সময় সাম্প্রতিক অতীতের বারাসাত জেলা পুলিশ সুপার ভাস্কর মুখোপাধ্যায় বা অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় যেভাবে সুনির্দিষ্ট ভাবনায় সাধারণ নাগরিকদের অসুবিধায় পড়তে দেননি তা যেন গরহাজির এবারের বারাসাতের কালীপুজোয়।

কেন এরকম অব্যবস্থা ও বিশৃঙ্খলা? বারাসাত শহরের ঐতিহ্যবাহী অন্যতম কালী পুজো কেএনসি পূজো মন্ডপে যেতেই আয়োজকরা একরাশ ক্ষোভ উগরে দিলেন পুলিশ প্রশাসনের বিরুদ্ধে। কে এনসি র এবারের থিম কার্যত বাঙালিয়ানা ও বাঙালি অস্মিতা জড়িয়ে। আয়োজকরা বললেন, বারাসত জেলা পুলিশের মাথায় শীর্ষ আধিকারিক হিসেবে যিনি রয়েছেন তিনি সম্ভবত বাঙালির নাড়ির খবর রাখেন না। কে এনসির পুজোর আয়োজক দের অন্যতম গৌতম মুখার্জী বললেন, বাঙালির সংস্কৃতি সম্পর্কে  শীর্ষ পুলিশ আধিকারিকের সম্ভবত সঠিক ধারণা না নেই। ফলে বাঙালির পুজো সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যে আঘাত আসছে।

বারাসাত জেলা পুলিশের শীর্ষ আধিকারিক তথা পুলিশ সুপার প্রতীক্ষা ঝাড়খড়িয়ার সঙ্গে পুজো আয়োজকদের বাদানুবাদ জারি ছিল পুজো শুরু হওয়ার আগেই। প্রতিজ্ঞা ঝাড়খরিয়া বলেছেন, বারাসাতের অনেক পুজো আয়োজকরা এই বেপরোয়া, কোনো দুর্ঘটনা ঘটলেই তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এভাবে পুজো আয়োজকদের হুমকি দিতে শোনা যায় নি অতীতে। কিন্তু হুমকি দিয়ে কী সুফল ঘটেছে? ভারতের বারাসাতের ঐতিহ্যবাহী পুজো রেজিমেন্টে মাতৃ প্রতিমাকে সোনায় মুড়ে দেওয়া হয়েছিল। সেখানে নিরাপত্তার দায়িত্ব নিতেই নারাজ পুলিশ। পুলিশে হস্তক্ষেপে বেশ কিছুক্ষণ মন্ডপে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি দর্শনার্থীদের। তাহলে? পুলিশ কী চাইছে? মানুষ যেন উৎসবের সামিল না হতে পারে? ব্যারিকেড আর কর্ডনে কলোনি মোড় ও হেলাবটতলা বিপর্যস্ত। আয়োজকরা অভিযোগ তুলছেন অনেকে বিভিন্ন প্রিয় পুজো গুলি ঘুরে দেখার সুযোগই পাচ্ছেন না পুলিশের অতি সক্রিয়তায়। পুলিশের নীল নকশায় উৎসবে যেন বিষাদের ছায়া। পুলিশের ক্রাউড ম্যানেজমেন্টে কলকাতার দূর্গা পুজোর কাছে বারাসাতের কালী পূজো যেন বিগ জিরো।অথচ এতদিন এরকমটা ছিল না। পুলিশের ভূমিকা আগে বারবার প্রশংসিত হয়েছে। বারাসাতের সাধারণ মানুষ ও কালীপুজোর দর্শনার্থীরা বলছেন কালীপুজোটা এবার সুখের সময়, আনন্দ উদযাপনের সময় হয়ে উঠল না।

আপৎকালীন চিকিৎসা পাওয়া  নিয়ে সংকট, একশ্রেণীর মানুষের রুজি-রুটির সংকট, বাঙালির পুজো সংস্কৃতির ঐতিহ্য ঘিরে সংকট, আয়োজক দের পুজো আয়োজন ঘিরে সংকট। সংকটের ষোল কলা পূর্ণ। কিছু কিছু মানুষ বলছেন ঘরে বসে বারাসাতের কালীপুজোর প্রতিবেদন শোনা ও ছবি দেখাই বরং নিরাপদ বিকল্প ব্যবস্থা। কিন্তু তাই বা হবে কী করে? সংবাদ মাধ্যমের ওপরেও যেন বিধি নিষেধ। সব জায়গায় প্রবেশের অধিকার যাদের, তাদেরকে পুজো কভার করতে দিতেও সমস্যা পুলিশ প্রশাসনের। সংকটনাশিনী কালীপূজোয় বারাসাতে সংকটের ঘট কানায় কানায় পূর্ণ পুলিশী অতি তৎপরতায়। সবমিলিয়ে ২০২৫ এর কালী পুজোয় পুলিশ প্রশাসনের অতি তৎপরতা নিয়ে হাজার প্রশ্নচিহ্ন ও জট -যে জট কাটিয়ে উঠতে উঠতে কালীপুজোর দিন যেন শেষ।।

 

About Post Author