পুরন্দর চক্রবর্তী, সময় কলকাতা, ৩০ আগস্ট :বাজি কারখানায় বিস্ফোরণ আর তাতেই নড়েচড়ে বসেছে মানুষ, উথালপাতাল রাজ্য-রাজনীতি । প্রতিদিন পালা করে বিরোধী নেতারা আসছেন, বক্তব্য রাখছেন, চলেও যাচ্ছেন। কোন দল নেই এতে? গণতন্ত্রের ধর্ম তাঁরা পালন করছেন। বেআইনি বাজি কারখানা চলছে পুলিশের নাকের ডগায় -এরকম অভিযোগ আনতে কেউ বাকি রাখেন নি। দত্তপুকুর থানাকে চাঁদমারি করতে কেউ কসুর করছেন না। কিন্তু পরিকাঠামোগত সমস্যার কথা কেউ ভেবে দেখছেন না। সমস্যার গভীরে তাঁরা ঢুকছেন না। সেই ” ৪৮ দিনের ” কথা তাঁরা মাথায় রাখছেন না। পুলিশ যে কতটা অসহায় তা বোঝাতে ” ৪৮ দিনের ” সিদ্ধান্ত যে কতটা প্রভাব ফেলছে তাও কেউ উল্লেখ করছেন না। ” ৪৮ দিনের ” মধ্যে কী সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হয়েছিল তা জানতে ফিরে যেতে হবে ফিরে যেতে হবে দশ বছর আগের উত্তর চব্বিশ পরগনার একটি গণধর্ষণ ও খুনের ঘটনায়।
মোচপোলের ভৌগোলিক অবস্থান
আলোচনায় ঢোকার আগে বাজি কারখানায় বিস্ফোরণের ঘটনাস্থলের ভৌগোলিক বিবরণ ও তার জটিলতা উল্লেখ করা দরকার।মুশকিল হল, গণমাধ্যম নির্ভর হলেই দেখা যাচ্ছে- শিরোনাম বলছে, দত্তপুকুরের বাজি কারখানায় বাজি বিস্ফোরণে নিহত ৯। অথচ দত্তপুকুরের কোনও মানুষ ঘটনার বহুপরেও জানতেন না – তাঁদের এলাকায় অর্থাৎ দত্তপুকুরে কোথায় বাজি কারখানাটি রয়েছে।আদতে দত্তপুকুরেই যে নয় বাজি কারখানা। যেখানে বাজি কারখানায় বিস্ফোরণ হয়েছে সেই বাজি কারখানাটির ঠিকানা হল – মোচপোল। জায়গাটির এলাকা,থানা, গ্রাম পঞ্চায়েত এবং বিধানসভা কেন্দ্র সবকিছুই আলাদা।এই মোচপোল জায়গাটি দত্তপুকুর থানার অধীনে অথচ জায়গাটি বারাসাত থানার খুব কাছে এবং মধ্যমগ্রাম বিধানসভা ও নীলগঞ্জ ইছাপুর পঞ্চায়েত এলাকায় পড়লেও এখানের বাসিন্দারা নিজেদের বারাসাতের লোক বলেই জানেন কারণ মোচপোলের কাছের তথা নিকটবর্তী বাজারঘাট, হাসপাতাল, শিক্ষাকেন্দ্র সবই বারাসাত। বিষয় হল বারাসাত লাগোয়া এরকম অনেক জায়গা রয়েছে (যেমন, ময়না ) যা বারাসাত থানা থেকে খুব কাছে অথচ এলাকাগুলি দত্তপুকুর থানার অধীনে। দশ বছর আগে এইসব জায়গাই ছিল বারাসাত থানার অধীনে এবং বারাসাত থানার পরিধি পরিসর এতটাই বড় ছিল কোনও অপরাধ বা দুর্ঘটনাস্থলে দ্রুত পৌঁছে যাওয়া অসম্ভব ছিল। এই সময় ঘটে হাড়হিমকরা একটি ঘটনা যার ফলে বারাসাত থানাকে একাধিক থানায় ভেঙে ফেলার প্রয়োজন বোধ করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
কী হয়েছিল ২০১৩ সালে?
২০১৩ সালের ৭ জুন উত্তর ২৪ পরগনার কামদুনিতে নৃশংসভাবে এক কলেজছাত্রীকে গণধর্ষণ ও খুন করা হয়। রাজ্য – রাজনীতিতে ঝড় ওঠে। কামদুনি ছিল বারাসাত থানার আমিনপুর ফাঁড়ির অন্তর্গত । ঘটনার দশ দিনের মাথায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কামদুনিতে আসেন। তিনি যুক্তিযুক্ত ভাবেই সঠিক কারণে উপলব্ধি করেন বারাসাত থানার এলাকা অনেক বড় এবং পুলিশবল পর্যাপ্ত নেই যে প্রত্যন্ত এলাকায় অপরাধ রুখতে পুলিশ সময়মত তৎপর হতে পারে।১৭ জুন কামদুনি সফরের সময় বারাসত থানাকে মুখ্যমন্ত্রী বিভক্ত করার প্রতিশ্রুতি দেওয়ার ৪৮ দিনের মধ্যে বারাসাত থানাকে চার ভাগে ভেঙে দেওয়া হয়। সেসময় বলা হয়েছিল আইনশৃঙ্খলা যথাযথ রাখতে ও মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য পুলিশিং জোরদার করার লক্ষ্যে বারাসত থানাকে চার ভাগে ভাগ করা হয়।বারাসাত থানা ছাড়া তিনটি নতুন থানা জন্ম নেয়।২০১৩ সালের আগস্ট মাসের দত্তপুকুর, মধ্যমগ্রাম এবং শাসন থানার অপর্যাপ্ত পুলিশবল এবং সেই মুহূর্তে হাতেগোনা মহিলা পুলিশ ২৬৮ বর্গ কিলোমিটারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য বারাসাত থানার হাতে ছিল।বিভক্ত হওয়ার আগে বারাসত থানার ২৬৮ বর্গ কিমি জুড়ে ছিল ১৬৯ জন পুলিশ।সেসময় কলকাতায়, ১০০ টিরও বেশি থানা থাকলেও সেই থানাগুলির এক্তিয়ার ছিল মোটের ওপরে ৫ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে। স্বাভাবিকভাবেই বারাসত থানাকে চার ভাগে বিভক্ত করা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ছিল। কিন্তু সমস্যা হয় অন্যত্র। মুখ্যমন্ত্রীর ভাবনা ও নির্দেশকে সিদ্ধান্ত থেকে বাস্তবে কার্যকর ৪৮ দিনেরর স্বল্প মেয়াদে এত দ্রুত কার্যকর করা হয় যে কিছু ভুল ত্রুটি থেকে যায়। মূলত দত্তপুকুর থানার অধীনে এমন বেশ কিছু এলাকা আসে যেখান থেকে বারাসত থানার ঢিলছোঁড়া দূরত্ব হলেও দত্তপুকুর থানা হয়ে ওঠে অনেক অনেক দূরবর্তী। শাসন ও দত্তপুকুর থানায় সেসময় কর্মরত পুলিশের সংখ্যাও ছিল কম।
কামদুনি গ্রামবাসীরা সে সময় অভিযোগ তুলেছিলেন, পর্যাপ্ত পুলিশ নিশ্চিত না করেই তাড়াহুড়ো করে নতুন থানা স্থাপন করা হয়েছে।
ভুল কোথায় হয়েছিল?
৪৮ দিনের সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেন নি অনেকেই। সেসময় নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কামদুনির এক বাসিন্দা বলেন, “শাসন থানা আমাদের গ্রাম পরিচালনা করবে,সেখানে ৮৪বর্গ কিলোমিটার এলাকা রয়েছে সেখানে মাত্র ১৬জন পুলিশ রয়েছে।” দত্তপুকুর থানার চিত্র ছিল সবচেয়ে করুণ কারণ ২০১৩ সালে থানা উদ্বোধনের সময় এখানে নিযুক্ত ছিলেন মাত্র ১৬ জন পুলিশ। সেসময় দত্তপুর থানার দায়িত্ব থাকা সঞ্জয় চক্রবর্তীকে মাঝেমধ্যেই মাথার চুল ছিঁড়তে হত প্রায় ১০৬ বর্গ কিলোমিটার এলাকা তদারকি করতে।অথচ ২০১৩ সালের আগস্ট মাসে বারাসাত থানায় ৯৭ জন পুলিশ কর্মচারী নিযুক্ত থাকলেও বারাসাত থানার এলাকা কমে হয় ২৮.৪ বর্গ কিলোমিটার। এই সমস্যা আজও রয়েছে। বেড়েছে পুলিশ কিন্তু জনসংখ্যা ও বেড়েছে। ২০১৩ সালের আগস্ট মাসে বারাসাতের
জনসংখ্যা ছিল ২ লক্ষ ৮৩ হাজার। দত্তপুকুরের জনসংখ্যা ছিল ২লাখ ৯২ হাজার। ১০৫.৫৮ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষার্থে দত্তপুকুর থানার পুলিশের মাথার ঘাম পায়ে পড়ে কারণ অনেক ক্ষেত্রেই বারাসাত বা অন্য থানার বিস্তীর্ণ অঞ্চলের মধ্যে দিয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছতে হয় দত্তপুকুর থানার পুলিশকে। দত্তপুকুর থানা এলাকার সুযোগসন্ধানী অপরাধীদের পোয়াবারো। দত্তপুকুর থানার জুরিসডিকসন বা এলাকা এত বিচ্ছিন্ন ভাবে ছড়ানো যে এলাকায় অপরাধীদের সুবিধে বেড়েছে।অপরাধ করলেও পুলিশ আসতে এক যুগ লেগে যাবে জেনে বিগত ১০ বছর ধরেই পুলকিত অপরাধীরা। ” ৪৮ দিনের ” সিদ্ধান্ত দ্রুত কার্যকর করতে গিয়ে দত্তপুকুরের এলাকায় এত এলোমেলো ভাবে বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে যে দত্তপুকুর থানার অধীনে অথচ থানার থেকে অনেকটা দূরে বাস করা অপরাধীদের ভালো লাগাই স্বাভাবিক । দশ বছর ধরেই বারাসাত জেলা পুলিশের আওতায় দত্তপুকুর থানার বিভিন্ন জায়গায় বেআইনি কাজ কারবারের বাড়বাড়ন্ত। বেআইনি কারবার ফেঁদে চলছে একশ্রেণীর লোক।
মুখ্যমন্ত্রী ঠিক থাকলেও ৪৮ দিনের সিদ্ধান্তে গোলমাল কোথায় হয়?
২০১৩ সালে আগস্ট মাসে তৎকালীন স্বরাষ্ট্র সচিব বাসুদেব ব্যানার্জি শাসন থানা উদ্বোধন উপলক্ষ্যে বলেন,যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মুখ্যমন্ত্রী তাঁকে এই কাজ করতে বলেছিলেন এবং তা তিনি করেছেন। ৪৮ দিনের প্রোগ্রাম ইমপ্লিমেন্ট করার এলাকার ভূগোল বা থানাপিছু পুলিশের অঙ্ক খতিয়ে দেখা হয় নি। স্বরাষ্ট্র সচিবের ‘দ্রুত’ কাজেরই হয়তো মাশুল দিচ্ছে পুলিশ ও জনগণ। তথাপি শিক্ষিত সমাজ প্রশ্ন তুলছেন। বিষয়টি লেখক ও চিন্তাবিদদের কাছে উত্থাপণ করলে, তাঁরা বলছেন অতিরিক্ত দ্রুততার সঙ্গে থানা বিভাজন করতে ত্রুটি যে থেকেছে এনিয়ে কোনও সন্দেহ নেই এবং অনেক ক্ষেত্রেই দত্তপুকুর থানা অসহায় কিন্তু সীমানা দিয়ে পুলিশের “তৎপরতার অভাব’ ঢাকা যাবে না। বলা হচ্ছে, বারাসাত জেলা পুলিশের বিভিন্ন থানার মধ্যে সমন্বয় ঘটাতে ব্যর্থ প্রশাসনের একটি অংশ। সর্বোপরি, ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো ব্যর্থ কেন?গোয়েন্দা রিপোর্ট ছিল না কেন? চিন্তাবিদরা পাল্টা যে প্রশ্নই তুলুন, এনিয়ে সন্দেহ থাকতে পারে না ২০১৩ সালে স্বরাষ্ট্র সচিবের আস্ফালন ব্যুমেরাং হয়ে ফিরছে। মুখ্যমন্ত্রীর ২০১৩ সালের সময়োপযোগী ও যুক্তিযুক্ত নির্দেশকে সঠিক ভাবে প্রয়োগ না করতে পারায় ভুগতে হচ্ছে বারাসাত জেলা পুলিশের এক বিরাট অংশকে, ভুগতে হচ্ছে মানুষকে।।
More Stories
ত্রিকোণ প্রেম নয়, পুলিশকে সাহায্য করাই কি কাল হয়েছিল হজরতের?
ভোটাভুটি আটকানো গেল না, জেলা সম্পাদকই হারলেন জেলা কমিটির ভোটাভুটিতে
রাষ্ট্রায়ত্ত দুই ব্যাঙ্কে কয়েক কোটি টাকার আর্থিক দুর্নীতি! FIR- এর নির্দেশ সিবিআই-কে