Home » সাংবাদিকের চোখে নতুন বাংলা বছর : পঞ্জিকা ও বাঙালির নস্টালজিয়া

সাংবাদিকের চোখে নতুন বাংলা বছর : পঞ্জিকা ও বাঙালির নস্টালজিয়া

সানী রায়, সময় কলকাতা :  ১২৭৬ বঙ্গাব্দ বা ১৮৬৯ সালে প্রথমবার ছাপার অক্ষরে বাংলা পঞ্জিকা প্রকাশ পেয়েছিল সে খবর তো রাখেন অনেকেই। ১৫৫ বছর পরে দিনভর খবরের কাজ সেরে ঠিক সন্ধ্যার শুরু এমন সময়ে উত্তরবঙ্গের এক সাংবাদিক তার সাংবাদিকতার রোজনামচা থেকে একটা বিশেষ দিন খুঁজে নিতে চায়। সে দিন সে একজন সাংবাদিকের পাশাপাশি একজন নির্ভেজাল সংস্কৃতিমনস্ক বাঙালি। তার জবানবন্দি, তার বয়ানে বাঙালির ঐতিহ্যের  স্মৃতি রোমন্থন , পঞ্জিকাকে ছুঁয়ে থেকে তার নববর্ষ পালনের ভাষ্য :

ধুপগুড়ির কাপড় পট্টির উদ্দেশ্যে ধুপগুড়ি প্রেস ক্লাব থেকে বেরিয়ে পড়ে মনে মনে ফন্দি আটছিলাম পহেলা বৈশাখের আগে ঠিক কোন রঙের পাঞ্জাবিতে আমাকে মানাবে। আর এই ভাবনাতেই ধুপগুড়ি পুরাতন মাছ বাজার ঢুকতেই নজরে আসলো লেখনি ঘর নামক একটি বইয়ের দোকান। যেখানে দেখা যাচ্ছে বছর একুশের এক যুবক একহাতে স্মার্টফোন ও অন্য হাতে কিছু একটা বই বা অন্য কিছু নিয়ে দেখছে। একটু সামনে গেলেই বুঝতে পারলাম, সে আর কেউ নয়, আমার সহকর্মী ঝিলাম দেবের ওষুধের দোকানের একজন স্টাফ জয় দাস। মুচকি হেসে বলল সানি দা, ওই মা একটা পঞ্জিকা নিয়ে যেতে বলল। ভালো করে দেখে নিচ্ছি পৃষ্ঠাগুলো ঠিক আছে কিনা। আমিও মুচকি হেসে বললাম চল ঠিক আছে নিয়ে যা। আসলাম রে তারা আছে। ডিজিটাল যুগেও জলপাইগুড়ি জেলার ধুপগুড়িতে চাহিদা কমেনি পঞ্জিকার। আর মাত্র হাতে গোনা কয়েকটা ঘণ্টার ব্যবধানে বাঙালি মাতবেন পয়লা বৈশাখের আমাজে। সদ্য ঘোষিত ধুপগুড়ি মহকুমায় নতুন জামা কাপড় কেনার হিড়িক লেগেই গেছে চৈত্র সেলের মধ্য দিয়েই ।

পয়লা বৈশাখের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে বাংলা পঞ্জিকা। বছরের প্রথম দিন পঞ্জিকার পাতা ওলটাতে ওলটাতে বাৎসরিক রাশিফল, পুজোর দিন, তারিখ দেখে নেওয়াটা বাঙালি জীবনের একটা নস্টালজিয়া। এখন সময় বদলেছে। ইন্টারনেট, সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে সবকিছুই হাতের মুঠোয়। দিনক্ষণ দেখার জন্য এখন আর আলাদা করে পঞ্জিকার পাতা ওলটাতে হয় না। তবে এই এসব কিছুর মাঝেও জলপাইগুড়ি জেলার ধুপগুড়ি শহরের বুকে ধরা পড়ল এক উলটো ছবি। দুধ হাটি, কলাহাটি ,মায়ের থান সহ বেশ কিছু জায়গার দশকর্মা ভাণ্ডারের দোকানগুলিতে পঞ্জিকা কিনতে ভিড় করলেন অনেকেই।
এদিন ধুপগুড়ি সিপিআইএম পার্টি অফিসের পাশে ক্ষুদ্র শিল্প বিপনির সামনে একটি দোকানে নাতিকে কোলে নিয়ে পঞ্জিকার পাতা ওলটাতে ওলটাতে সনৎ দত্ত বলেন, এখন সবার হাতে হাতে বলতে গেলে আট থেকে আসি অ্যানড্রয়েড ফোন, ইন্টারনেটের সুবিধা থাকা সত্ত্বেও পঞ্জিকার জুড়ি মেলা ভার। পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন জয়ন্ত মজুমদার। তাঁর দিকে উঁকি মারতেই তিনি বলেন, মোবাইলে কোনও সামাজিক অনুষ্ঠানের দিনক্ষণ দেখে ভরসা পাই না। যতক্ষণ না পঞ্জিকা দেখব তৃপ্তি আসে না।
এদিকে মুন্না, ভজো, প্রদীপ দের অধিকাংশ দোকানদারের বক্তব্য, পয়লা বৈশাখ আসার আগে থেকেই দোকানে পঞ্জিকার খোঁজ লেগে যায়। এক-একটি বান্ডিলে ৩০ পিস করে থাকে। কেউ ২০, আবার কেউ ৩০টির বান্ডিল কেনেন। এমনও হয়, পরেও কেউ কেউ পঞ্জিকা চান। স্টক শেষ হলে নিয়ে আসতে হয়। পঞ্জিকার চাহিদা কমবে না বলেই তাঁরা দাবি করেন। ২০২৪ এ দাঁড়িয়ে আজকাল মোবাইল অ্যাপে উঁকি দিচ্ছে পঞ্জিকা। শুধু তাই নয় গোটা পঞ্জিকাটিকেই স্মার্টফোনের বিভিন্ন অ্যাপে পাওয়া যায়। তবুও বাড়িতে পঞ্জিকা থাকলে পূজার্চনায় বেশ সুবিধে হয় বলেই জানান গৃহবধূ আথিকা দত্ত দেব । তিনি বলেন, বিয়ের আগে থেকেই মা-বাবার কাছ থেকে আমি অনেক ধৈর্য নিয়ে পঞ্জিকা দেখা শিখেছিলাম। এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের কাছে মোবাইল চালানো বাদ দিয়ে পঞ্জিকা দেখা শিখতে যাওয়া মানে ওয়েস্ট অফ টাইম। তবে অবশ্য খট্টিমারি বাজারের পুরোহিত নিরঞ্জন চক্রবর্তী , চন্দন চক্রবর্তী রা ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিয়ে, অন্নপ্রাশন, উপনয়নের সময়, তারিখ, তিথি, নক্ষত্র দেখা একদমই পছন্দ করেন না। তাঁদের মতে, ‘পঞ্জিকাই বেস্ট। এর কোনও বিকল্প নেই।
ডিজিটাল যুগে পুরোনো অনেক কিছুই ব্রাত্য হতে বসেছে। কিন্তু নববর্ষের আগে পুরোনো সেই চাহিদা এখনও ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে বাংলা পঞ্জিকা। ধরে রাখবে নাই বা কেন? কবে একাদশী, দুর্গাপুজোর নির্ঘণ্ট কী, কবে অম্বুবাচি, বাড়ির ভিতপুজোর তিথি অনুযায়ী শুভক্ষণ কখন? সমস্ত প্রশ্নের উত্তর যে রয়েছে একমাত্র বাঙালির পঞ্জিকাতেই।

 সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেছিলেন,’ তেত্রিশ বছর কাটল, কেউ কথা রাখে নি ‘। তবে পঞ্জিকা কথা রাখে,১৫৫ বছর ধরে সে কথা রেখে চলেছে। সে শুভ দিনের মাঙ্গলিক  তিথি- নক্ষত্রের কথা বলবেই। বলে চলেছে। জন্ম-মৃত্যু কারও হাতে নেই , তবে অন্নপ্রাসন থেকে বিবাহ, এবং উৎসব উদযাপন পঞ্জিকার হাত ধরে। সে শুভ দিনের কথা বলে আসছে অন্তত ১৫৫ বছর ধরে। ভেদাভেদহীন ভাবে সে রয়েছে সমস্ত বাঙালির জীবনে। বাঙালি জীবনে যাবতীয় ওঠা পড়া মিশে আছে পঞ্জিকার নস্টালজিয়ায়।।

About Post Author