সময় কলকাতা ডেস্ক, ৩১ মেঃ অধুনা বঙ্গ রাজনীতির ভরকেন্দ্র কলকাতা দক্ষিণ। রাজ্যের ৪২ টি লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে অন্যতম। অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচনের সপ্তম দফায় এই কেন্দ্রে রয়েছে ভোটগ্রহণ। কেন্দ্রটি তৃণমূল কংগ্রেস ও দলের সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দুর্গ বলেই পরিচিত। তৃণমূল নেত্রীর যাবতীয় রাজনৈতিক লড়াইয়ের সাক্ষী কলকাতার দক্ষিণ বলয়। সিপিএমের সূর্য যখন মধ্যগগনে, তখন এই কেন্দ্র থেকে টানা ছয়বার জয়ী হয়েছিলেন তিনি। এটি একমাত্র কেন্দ্র যেখানে এখনও অপরাজেয় ঘাসফুল শিবির। চব্বিশের লোকসভা নির্বাচনে এই হেভিওয়েট কেন্দ্রে নারীশক্তির লড়াই। বিদায়ী সাংসদ মালা রায়ের উপর আস্থা রেখেছে দল। বিজেপি প্রার্থী করেছে প্রাক্তন কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী দেবশ্রী চৌধুরীকে। আর সিপিএম প্রার্থী করেছে সায়রা শাহ হালিমকে। যিনি বিধানসভার প্রাক্তন স্পিকার হাসিম আব্দুল হালিমের পুত্রবধূ। এই নির্বাচনেও দক্ষিণ কলকাতায় নিজেদের গড় ধরে রাখতে পারবে রাজ্যের শাসক দল? নাকি মালা-বদলের সাক্ষী থাকবে এই কেন্দ্র? কী বলেছে দক্ষিণ কলকাতার রাজনৈতিক ইতিহাস?
স্বাধীনতার পর দেশে প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৫২ সালে। তখন এই কেন্দ্রের নাম ছিল কলকাতা দক্ষিণ-পূর্ব। এই আসনটি থেকে জয়ী হয়েছিলেন ভারতীয় জনসংঘের প্রতিষ্ঠাতা শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি। ১৯৫৭ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত এই আসনটির নাম ছিল কলকাতা পূর্ব। সেই দশবছর কেন্দ্রটি ছিল সিপিআইএমের দখলে। প্রথমে সাধন গুপ্ত ও পরে রনেন্দ্রনাথ সেন এই কেন্দ্র থেকে কাস্তে-হাতুড়ি-তারা চিহ্নে জয়ী হয়েছিলেন। ১৯৬৭ সালে ফের নাম বদল করে কলকাতা দক্ষিণ লোকসভা কেন্দ্রটি গড়ে ওঠে। প্রথম বছরেই সিপিআইএমের টিকিটে এই কেন্দ্র থেকে জয়ী হয়েছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী গনেশ ঘোষ। ১৯৭১ সালে এই কেন্দ্রটি দখল করে কংগ্রেস। জয়ী হয়েছিলেন প্রিয় রঞ্জন দাশমুন্সি। তারপর থেকে কখনও সিপিআইএম তো কখনও কংগ্রেস এখানে প্রভাব বিস্তার করেছে। ১৯৯১ সাল থেকে কলকাতা দক্ষিণে শুরু হয় ‘মমতা’ অধ্যায়ের। সেই বার কংগ্রেসের প্রতীকে জয়ী হয়ে সংসদে পৌঁছন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৯৯৫ সালেও কংগ্রেস প্রার্থী হিসেবে তিনি জয়লাভ করেন। ১৯৯৮ সালে তৃতীয় বারের জন্য জয়ী হন মমতা। তবে সেবার আর কংগ্রেসের প্রতীকে নয়। ততদিনে রাজ্য রাজনীতিতে জন্ম হয়ে গিয়েছে তৃণমূল কংগ্রেসের। নিজের দল তৃণমূল কংগ্রেসের ঘাসফুল প্রতীকে তিনি জয়লাভ করেন। ১৯৯৮ সাল থেকে ২০১১ পর্যন্ত টানা ১৩ বছর দক্ষিণ কলকাতাবাসী নিজের মেয়েকেই সাংসদ হিসেবে বেছে নিয়েছেন। কালীঘাটের মেয়েও ততদিনে বাংলার রাজনীতির আঙিনা পেরিয়ে, নিজেকে জাতীয় রাজনীতিতে সুপ্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছেন।
২০১১ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে রাজ্য-রাজনীতিতে পালাবদল ঘটে। সাংসদ ও কেন্দ্রীয় রেলমন্ত্রীর পদ ছেড়ে তিনি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। মমতার ছেড়ে যাওয়া আসনে তৃণমূল প্রার্থী করে দলের প্রবীণ নেতা সুব্রত বক্সির ওপর। সেই বছর উপনির্বাচনে কলকাতা দক্ষিণ থেকে বিপুল ভোটে জয়ীও হন তিনি। ২০১৪ সালেও এই কেন্দ্রে সাংসদ বদল হয়নি। বরং সিপিএমকে পিছনে ফেলে দ্বিতীয় স্থানে উঠে আসে বিজেপি। সুব্রত বক্সি পেয়েছিলেন ৩৬.৯৫ শতাংশ ভোট। দ্বিতীয় স্থানে থাকা বিজেপি প্রার্থী তথাগত রায় পেয়েছিলেন ২৫.২৮ শতাংশ ভোট। ২৩.৮৩ শতাংশ ভোট পেয়ে তিন নম্বরে ছিলেন সিপিআইএম প্রার্থী নন্দিনী মুখার্জি। গতবার লোকসভা নির্বাচনে প্রার্থী বদল করে তৃণমূল। বিদায়ী সাংসদ সুব্রত বক্সির পরিবর্তে প্রার্থী করা হয় মালা রায়কে। তিনি হারিয়ে দেন বিজেপির চন্দ্র কুমার বসুকে। ৪৭.৫০ শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন তৃণমূল প্রার্থী। বিজেপির ঝুলিতে যায় ৩৪.৬৪ শতাংশ ভোট।
চব্বিশের লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতীকে লড়ছেন বিদায়ী সাংসদ মালা রায়। গত ১১ মার্চ ব্রিগেডের জনগর্জন সভামঞ্চ থেকে তাঁর নাম ঘোষণা করেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। দ্বিতীয় বারের জন্য কলকাতা দক্ষিণ থেকে নির্বাচিত হওয়ার বিষয়ে আশাবাদী মালা। এই কেন্দ্রের অন্তর্গত মোট ছয়টি বিধানসভা কেন্দ্র রয়েছে। সেগুলি হল: কসবা, বেহালা পূর্ব, বেহালা পশ্চিম, কলকাতা পোর্ট, ভবানীপুর, রাসবিহারী ও বালিগঞ্জ। এই সাতটি কেন্দ্রেই গত বিধানসভা নির্বাচনে একচেটিয়া দাপট দেখায় তৃণমূল। প্রতিটি কেন্দ্রে জয়লাভ করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলের সৈনিকরা। প্রায় ৫৮ শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন তাঁরা। এর একটা বড় কারণ অবশ্যই সংখ্যালঘু-ভোট। এই কেন্দ্রে সেই সংখ্যাটা ২৭ শতাংশেরও বেশি। কলকাতা বন্দর, বালিগঞ্জ, কসবায় যেমন সংখ্যালঘু ভোটের প্রভাব রয়েছে, তেমনই মধ্যবিত্ত বা অভিজাত শ্রেণীর হিন্দু ভোটারও রয়েছে এই লোকসভার অন্তর্গত বিভিন্ন কেন্দ্রে। ভবানীপুর, বালিগঞ্জে প্রচুর হিন্দীভাষী ভোটারও রয়েছেন। যারা দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসে এখানে কয়েক পুরুষ ধরে বসবাস করছেন।
গত লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থী মালা রায় এই কেন্দ্র থেকে জয়ী হয়েছিলেন প্রায় দেড় লক্ষ ভোটের ব্যবধানে। কিন্তু, দক্ষিণ কলকাতার মোট ৫৮ টি ওয়ার্ডের মধ্যে ২৬ টি ওয়ার্ডে এগিয়ে ছিল পদ্মশিবির। এ বার সেই সব ওয়ার্ডেও লিড নিতে আসরে নেমেছে ঘাসফুল শিবির। ওই কেন্দ্রের অধীনে যে ক’টি পুরসভা রয়েছে, সেগুলির পুরপ্রতিনিধিদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির দায়িত্বে রয়েছেন রাসবিহারী কেন্দ্রের তৃণমূল বিধায়ক দেবাশিস কুমার। পিছিয়ে পড়া এলাকাগুলিতে বাড়তি জনসংযোগে জোর দিয়েছেন তৃণমূল প্রার্থীও। এমনিতেই এই কেন্দ্রে তৃণমূলের বুথভিত্তিক সংগঠন খুব মজবুত। সুব্রত বক্সি, ফিরহাদ হাকিম, দেবাশিস কুমার, জাভেদ খানদের মত দক্ষ সংগঠকরা রয়েছেন তৃণমূল প্রার্থীর সঙ্গে। সর্বোপরি রয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এই লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত ভবানীপুর বিধানসভা থেকে জয়ী হয়ে তৃতীয় বারের জন্য মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হন তিনি। সব মিলিয়ে শুধু জয় নয়, গত বারের তুলনায় ব্যবধান আরও বাড়িয়ে নেওয়াই লক্ষ্য মালার।
আরও পড়ুনঃ Lok Sabha Election 2024: দমদম লোকসভা কেন্দ্রের কুর্সি দখলের লড়াইয়ে আসল ‘দম’-দার কে?
দক্ষিণ কলকাতা মানেই তৃণমূলের কাছে সব ‘রয়েছে’র দেশ। এত থাকার মাঝেও চিন্তার অন্ত নেই শাসক শিবিরে। কারণ গত পাঁচ বছরে রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে উঠেছে ভুরিভুরি দুর্নীতির অভিযোগ। শাসক দলের একাধিক রাঘব বোয়ালের নাম উঠে এসেছে। নিয়োগ দুর্নীতিকাণ্ডে ইতিমধ্যে গ্রেফতার হয়েছেন দলের প্রাক্তন মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়। তাঁর বান্ধবীর ফ্ল্যাট থেকে রাশি রাশি টাকার নোট উদ্ধারের ঘটনা এখনও বঙ্গবাসীর মনে টাটকা। সেই পার্থ চট্টোপাধ্যায় দক্ষিণ কলকাতা লোকসভা কেন্দ্রের বেহালা পশ্চিমের দীর্ঘদিনের বিধায়ক। এই ঘটনা যে দলের মুখ পুড়িয়েছে, সেবিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। যদিও গ্রেফতার হওয়ার পর দীর্ঘদিনের সৈনিককে ছেঁটে ফেলেছে তৃণমূল। কিন্তু তাতে সব দায় ঝেড়ে ফেলা যায় কি? আর এই বিষয়গুলিকে হাতিয়ার করে ময়দানে নেমে পড়েছে বিরোধীরা। তাদের আশা লাগাতার দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় তৃণমূলের দিক থেকে মুখ ফেরাবে জনগণ। এই কেন্দ্রটির দিকে অনেকদিনের নজর রয়েছে বিজেপির। গত দশ বছরে এই কেন্দ্রে প্রায় ৩০ শতাংশের কাছাকাছি ভোট বাড়িয়েছে তারা। এ বার এই কেন্দ্রে তৃণমূল মিথ ভাঙতে মরিয়া কেন্দ্রের শাসক দল। রায়গঞ্জের বিদায়ী সাংসদ ও প্রাক্তন কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী দেবশ্রী চৌধুরীকে এই কেন্দ্রে প্রার্থী করা হয়েছে। রায়গঞ্জ থেকে দক্ষিণ কলকাতার মত শক্ত আসনে তাঁকে প্রার্থী করা নিয়ে চাপানউতোর কম হয়নি। যদিও বিজেপি প্রার্থীর দাবি, শাসক দলের গড় ভাঙার যুদ্ধে তিনি নেমেছেন। এই লড়াইয়ে তাঁর পুঁজি আটবছর এই সব এলাকায় সংগঠনের কাজ করা।
দক্ষিণ কলকাতায় গতবার বামেদের ও কংগ্রেসের ভোট ছিল যথাক্রমে ১১.৮০ শতাংশ ও ৩.৬০ শতাংশ। একদিকে রাজ্য সরকারের দুর্নীতি ও অন্যদিকে কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে বামেরা। এই কেন্দ্রে কংগ্রেসের সমর্থনে বামফ্রন্ট মনোনিত সিপিআইএমের প্রার্থী সায়রা শাহ হালিম। সম্পর্কে তিনি বলিউডের অভিনেতা নাসিরুদ্দীন শাহের ভাইঝি এবং প্রাক্তন সেনা কর্তা জামিরুদ্দীন শাহের মেয়ে। ২০২২ সালে বালিগঞ্জ বিধানসভা উপনির্বাচনে তিনি রাজ্যের শাসক দলকে কড়া প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ফেলে দিয়েছিলেন। বিজেপিকে তিন নম্বরে নামিয়ে দ্বিতীয় স্থানে উঠে আসে সিপিআইএম। প্রায় ২৪.৪৫ শতাংশ ভোটবৃদ্ধি পায় তাদের, যা বাম শিবিরকে অক্সিজেন জোগাচ্ছে। গতবারের তুলনায় বেশ কয়েকটি ওয়ার্ডে অতীতের থেকে ভাল ফল করার ব্যাপারে আশাবাদী অজমেঢ়ের সোফিয়া কলেজের প্রাক্তনী সায়রা।
ধারে ও ভারে এই কেন্দ্রে নিঃসন্দেহে এগিয়ে রয়েছে রাজ্যের শাসক দল। কিন্তু রাজনীতি সম্ভাবনার শিল্প। এই প্রাচীন প্রবাদকে আপ্তবাক্য মেনে আশায় বুক বাঁধছে বিরোধীরা। কিন্তু তাদের জন্য ফ্যাক্টর একটাই, এটা “মমতার কেন্দ্র”।
More Stories
তৃণমূলের জেলা-ব্লক প্রেসিডেন্ট বদল এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা, সংগঠনের রাস অভিষেকের হাতে
আগামী সপ্তাহে ফুরফুরা শরিফ যাচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী , নবান্নে নওশাদের সঙ্গে বৈঠকের এক সপ্তাহ পরই সফর
ভোটার তালিকায় ‘ভূত’ ধরতে আরও কড়া অভিষেক , ৫ দিনের মধ্যে জেলাভিত্তিক কমিটি গঠনের নির্দেশ