Home » জাতির জনক গান্ধীজিকে কেন হত্যা করেছিলেন নাথুরাম গডসে?

জাতির জনক গান্ধীজিকে কেন হত্যা করেছিলেন নাথুরাম গডসে?

পুরন্দর চক্রবর্তী, সময় কলকাতা :জাতির জনক  গান্ধীজির প্রয়াণ দিবস ৩০ জানুয়ারি। দেশজুড়ে পালিত হচ্ছে শহীদ দিবস। ১৮৬৯ সালের গুজরাটে ( পোরবন্দর) ২ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করা স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। ভারতছাড়ো আন্দোলন , সত্যাগ্রহ আন্দোলন সহ একাধিক অহিংস আন্দোলনের কান্ডারি ছিলেন মহাত্মা। ১৯৪৮ সালের এদিনটিতে জাতির জনক বাপুজিকে গুলি করে হত্যা করেছিলেন তাঁর স্বদেশেরই এক মানুষ নাথুরাম গডসে । বলা হয়,গডসে প্রকাশ্যে গান্ধীজিকে হত্যা করে পালাতেও চেষ্টা করেন নি।আদালতে তাঁর বিচার চলে দীর্ঘ সময় ধরে।এই নৃশংস হত্যার পেছনে তাঁর ‘জাতি -সম্প্রদায় ও স্বদেশ বোধের’ উল্লেখ করে তিনি আত্মপক্ষ সমর্থনে আদালতের সামনে নিজের জবানবন্দী রাখেন। নাথুরাম চেয়েছিলেন কেন তিনি এই হত্যা করেছিলেন তা দেশবাসী জানুক।

কেন তিনি গান্ধীজিকে হত্যা করেছিলেন তার উল্লেখ রয়েছে নাথুরাম গডসের বয়ানে প্রকাশিত ‘হোয়াই আই কিলড গান্ধী’ বইয়ে। এই বইটি মূলত ৬৫৫ দিন ধরে চলা গান্ধী- হত্যায় নাথুরাম গডসের জবানবন্দি। নাথুরাম গডসে কোনও উকিল না নিয়োগ করে আত্মপক্ষ সমর্থনে নিজের বক্তব্য তুলে ধরেন। তাঁর আত্মপক্ষ সমর্থন ও তাঁর জবানবন্দি পুস্তকাকারে প্রকাশ পায় অনেক টানা পোড়েনের শেষে ।বাংলা – ভাষায় এই বইয়ের একাধিক অনুবাদ হয়েছে। সেখানেই গান্ধীজিকে হত্যার পেছনে নাথুরাম গডসের কোন মানসিকতা কাজ করেছিল তা বিবৃত যদিও এই বইপ্রকাশ ঘিরেও বিভিন্ন বাধানিষেধের বেড়াজাল ছিল।

গান্ধী খুনের ঘটনায়, নাথুরাম গডসের সাথে ষড়যন্ত্রকারী ও সহযোগী হিসেবে নাথুরামের ভাই গোপাল গডসে সহ আরও সাতজনকে অভিযুক্ত করা হয়। গডসে আদালতে উপনীত হয়ে কোনোরকম সংঘবদ্ধ ষড়যন্ত্রের কথা অস্বীকার করেন। আদালতের দেওয়া গডসের বক্তব্য জনসম্মুখে যেন প্রকাশ না হয়, সে জন্য নেহেরু নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস সরকার তা প্রকাশ না করার  আইন পাশ করে। ফলে দীর্ঘদিন তাঁর জবানবন্দী অন্ধকারেই থেকে যায়। কিন্তু ১৯৬৮ সালে বোম্বে হাইকোর্টে দায়ের করা একটি জনস্বার্থ মামলায় আদালত গডসের জবানবন্দি প্রকাশের পক্ষে রায় দিলে সামনে আসে গডসের ভাবনা। ১৯৭৭ সালে গান্ধী হত্যার আপিল মামলার একজন বিচারপতি, জি.ডি খোসলা, নাথুরামের জবানবন্দি এবং বিচার সম্পর্কিত নানা বিষয় নিয়ে একটি বই লিখেন। নাথুরামের সহোদর গোপাল গডসেও এ বিষয়ে আলোকপাত করেন।

নাথুরাম গডসের জন্ম ১৯১০ সালে। মারাঠি ব্রাক্ষণ পরিবারে তাঁর জন্ম। তিনি ছিলেন উগ্র জাতীয়তাবাদী। হিন্দু জাতপাত প্রথার বিরোধী নাথুরাম বিশ্বাস করতেন যোগ্যতার ভিত্তিতেই উচ্চ- নীচ ভেদাভেদ হতে পারে।তাঁর জবানবন্দি থেকে জানা যায় তিনি বিদেশ ও স্বদেশ নিয়ে প্রচুর পড়াশোনা করেছিলেন। স্বামী বিবেকানন্দ, গোখলে, তিলকের ওপরে তাঁর প্রচুর পড়াশোনা ছিল। তবে তিনি সম্যক ভাবে পাঠ করেছিলেন বীর সাভারকর ও গান্ধীজির লেখা বই ও তাঁদের বক্তৃতা। তিনি জানিয়েছেন গান্ধীজির লেখা বই তাঁর ৩৯বছরের জীবনকালের মধ্যে প্রায় ত্রিশ বছর ধরে পড়েছিলেন। গান্ধীজি ও সাভারকারের পড়ে প্রভাবিত ছিলেন তিনি। তিনি জানিয়েছিলেন, এই দুজন মানুষের চিন্তা ও কার্যকলাপ তাঁকে যতদূর প্রভাবিত করেছিল, অন্য কোনও ব্যক্তির চিন্তা ও আদৰ্শ সেভাবে তাঁকে প্রভাবিত করতে সক্ষম হয় নি। এতদসত্বেও এহেন ব্যক্তি কেন হত্যা করলেন গান্ধীজিকে?

মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীকে, নাথুরাম গডসে, ১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি, বিকেল ৫ টায় নিউদিল্লির বিড়লা হাউসের সামনে প্রাঙ্গনে গুলি করে হত্যা করেন । সেই সময় গান্ধী ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট থেকে শুরু হওয়া সাম্প্রদায়িক হানাহানি বন্ধে বিভিন্ন মন্দিরে মন্দিরে গান্ধীর আয়োজনে যে প্রার্থনা সভায় যোগ দিতে যাচ্ছিলেন। ‘হিন্দু শিখ নিধনের ‘মাঝে শান্তির বাণী শোনানো মহাত্মা গান্ধীকে হত্যার পরিকল্পনা তখনই বাস্তবায়িত করেন নাথুরাম গডসে। হত্যার দিন নাথুরাম গডসে পয়েন্ট ব্ল্যাংক রেঞ্জ থেকে পর পর তিনটি গুলি করেছিলেন । গান্ধীজির প্রয়াণ ছিল এমন এক দেশনায়কের হত্যাকাণ্ড যা দেশকালের সীমানা ছাড়িয়ে জনমানসে প্রভুত প্রভাব ফেলে।

 

হত্যাকান্ডের বিচার চলেছিল প্রায় দুবছর।১৯৪৯ সালের ৮ নভেম্বর তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় যা কার্যকর হয় ১৫ নভেম্বর। দীর্ঘ মামলা চলাকালীন তিনি গান্ধীজির আদর্শের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন গান্ধী ও সাভারকারের চিন্তা ও আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়েই হিন্দুত্ব প্রতিষ্ঠা করাই তাঁর কাজ হিসেবে জ্ঞান করেন।মহাত্মা গান্ধীর আদর্শে দীক্ষিত হলেও স্বাধীনতার আগে ও পরে গান্ধীর কাজে তিনি অতিশয় ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন।তাঁর জবানবন্দীতে দেশভাগ, হিন্দু হত্যা ও সংখ্যালঘু তোষণের জন্য জন্য গান্ধীজিকে প্রত্যক্ষভাবে দায়ী করেন তিনি।

১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট দেশের স্বাধীনতা হয় দেশ বিভাজনের মাধ্যমে। বিষয়টি মানতে পারেন নি নাথুরাম।তিনি জানিয়েছিলেন, স্বাধীনতার সময় কংগ্রেস ঠিক করে যে তারা ভারত বিভাজনের বিরোধীতা করবে। কিন্তু গান্ধী সেই দেশ ভাগের সমর্থন করায় তা আর বাস্তবায়িত হয় নি । এর আগে গান্ধী নিজেই বলেছিলেন দেশ ভাগ তার লাশের ওপর দিয়ে হবে। নাথুরাম জানিয়েছিলেন, গান্ধীজি শ্রদ্ধেয় হলেও দেশ বিভাগ ও নিরীহ দেশবাসীর নিধনে গান্ধীজির ভূমিকা ছিল ক্ষমার অযোগ্য। নাথুরাম গডসে তাঁর জবানবন্দিতে এই কারণের বিস্তারিত উল্লেখ শেষে জানিয়েছিলেন কেন গান্ধী হত্যার চরম পথ বেছে নিয়েছিলেন  ।।

About Post Author