Home » টিনটিনের লিঙ্গ নিয়ে কেন কাটাছেঁড়া?

টিনটিনের লিঙ্গ নিয়ে কেন কাটাছেঁড়া?

পুরন্দর চক্রবর্তী, সময় কলকাতা : কমিক সিরিজ বললেই টিনটিনের ছবি যেন প্রত্যেকের চোখে ভেসে ওঠে। কমিক স্ট্রিপ সিরিজের বর্ণময় চরিত্র টিনটিন এক সাংবাদিক। টিনটিন তার সঙ্গী সাথীদের নিয়ে যে আশ্চর্য কান্ডকারখানা ঘটিয়ে চলত তা নব্বই বছরের বেশি সময় ধরে অসম্ভব জনপ্রিয়। টিনটিন সিরিজের চব্বিশটি বই পঞ্চাশটির বেশি ভাষায় অনুবাদ হয়েছে। টিনটিনের বিস্ময়কর জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়ে নি আজও। কে ছিল এই টিনটিন? বাস্তবের কোনও চরিত্র কি টিনটিন হয়ে হার্জের বর্ণনায় স্থান পেয়েছে? এর সাথে যোগ হয়েছে টিনটিনের লিঙ্গনির্ধারণ।হালে ফরাসি দার্শনিক টিনটিনকে যৌন লক্ষণ হীন মেয়ে বলার পরে টিনটিন মেয়ে না ছেলে তা নিয়েও চলছে পর্যালোচনা।

টিনটিন চরিত্রটি বেলজিয়ামের  শিল্পী জর্জ পি রেমি (১৯০৭–১৯৮৩)- র সৃষ্টি । হার্জ ছদ্মনামে এই কমিক সিরিজটি রচনা করেন তিনি । ১৯২৯ সালের ১০ জানুয়ারি ‘ল্য ভাঁতিয়েম সিয়েক্‌ল ‘ বেলজিয়ামের সংবাদপত্রের  শিশুদের বিভাগে  ফরাসি ভাষায় সর্বপ্রথম এই সিরিজটি প্রকাশিত হতে শুরু করে । টিনটিনকে নিয়ে একটি সফল পত্রিকা প্রকাশিত হয়। এই সিরিজের বইয়ের কপি বিক্রির সংখ্যা এখন কুড়ি কোটির বেশি।

টিনটিনের রূপকার হার্জ ছিলেন বিংশ শতকের মানুষ।স্বভাবতই,টিনটিন সিরিজের পটভূমি ছিল প্রধানত বাস্তব বিংশ শতাব্দীর দুনিয়া।যে যুগের প্রেক্ষাপটে হার্জ টিনটিনের এই পরিচয়টি তার একাধিক অভিযানের বর্ণনায় ব্যবহার করেছেন, সেই যুগটি ছিল রাশিয়ায় বলশেভিক বিপ্লব ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের যুগ। এমনকি বাস্তবে চন্দ্রাভিযানের বহু আগেই তিনি তার কল্পনায় চাঁদে টিনটিনের অভিযানের গল্প শুনিয়েছেন। অভূতপূর্ব ফ্যান্টাসির দক্ষ রচয়িতা জুল ভার্ণের সাথে যেন টিনটিনের যোগসূত্র ফুটে উঠতে দেখা গেছে হার্জের লেখা কমিক স্ট্রিপে। কল্পনার জগতে অকল্পনীয় অভিযানের নায়ক ছিল টিনটিন। টিনটিন ছিল এমন এক সাংবাদিক যে কিনা ছিল ভু-পর্যটকও।

প্রথম থেকেই বিভিন্ন অভিযানে তার সর্বক্ষণের সঙ্গী থেকেছে পোষা ফক্স টেরিয়র যার নাম ফরাসিতে মিলু আর ইংরেজিতে স্নোয়ি। বাংলা ভাষায় টিনটিনের অনুবাদক নীরেন্দ্র নাথ চক্রবর্তীর সৌজন্যে তাকে   কুট্টুস বলেই অনেকে জানে। পরবর্তীকালে তার অভিযানের সঙ্গী হন মজাদার অথচ একরোখা নাবিক ক্যাপ্টেন হ্যাডক; প্রতিভাবান অথচ কানে খাটো প্রফেসর ক্যালকুলাস এবং অপদার্থ গোয়েন্দা টমসন ও থম্পসন  (জনসন ও রনসনের ) মত কিছু পার্শ্বচরিত্র। কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে সেই টিনটিন যাকে নিয়ে জিজ্ঞাসা আর কৌতূহলের অন্ত নেই। হার্জ সংবাদপত্রের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও সাংবাদিক ছিলেন না। একদিন ওই পত্রিকার কর্তৃপক্ষ হার্জকে সংবাদপত্রের শিশুদের বিভাগের জন্য মনকাড়া চরিত্রের ছবি আঁকতে বললে আত্মপ্রকাশ হয় টিনটিনের। কিন্তু আদতে কে ছিল টিনটিন?তর্ক-বিতর্ক, বাদানুবাদ চলছে বহুদিন ধরেই। রহস্যের ঘেরাটোপ কাটিয়ে বিভিন্ন ভাবে পর্যালোচনা করলেও বিতর্ক যেন আরও জমাট হয়ে ওঠে। দার্শনিক ভিনসেন্ট সেসপেদেশ টিনটিনকে মেয়ে হিসেবে দাবী করায় বিতর্ক আরও তীব্র মাত্রা পায়। পাশাপাশি,টিনটিন চরিত্রটিতে আরও দুজনের প্রভাবের কথা উঠে এসেছে। ডেনমার্কের পেল হাল্ড ও ফরাসি রবার্ট সেকসে দুজনেই প্রায় গোটা বিশ্ব ভ্রমণ করেন। তাঁদের গতিবিধির সঙ্গে টিনটিন চরিত্রের সাদৃশ্য থাকায় তাঁরা যেকেউ হয়ে উঠতে পারেন টিনটিন সৃষ্টির অনুপ্রেরণা। কিন্তু এ সম্পর্কে হার্জের সুস্পষ্ট বক্তব্য আজ আর পাওয়ার অবকাশ নেই।

এতসব কিছুর মধ্যেও ভিনসেন্ট সেসপেদেস টিনটিন নিয়ে বছর পাঁচেক আগে যা বলেন তা কিন্তু আলোড়ন ফেলে দেয়। ফরাসি দার্শনিকের মতে চরিত্রায়ণ হওয়া টিনটিন একজন মেয়ে। স্কটল্যান্ডে তার স্কার্ট পরিধান বা টিনটিনের পিকারোদের মহিলাদের সাজে সজ্জাকরণ, টিনটিনের চালচলন দেখে তাকে টিনএজ ‘ যৌন লক্ষণহীন ” মেয়ে বলে বর্ণনা করেন। কারণ হিসেবে তার নারীসুলভ নমণীয়তা আর কোমল আচরণকে তুলে ধরেন। ফরাসী দর্শনিকের মতে টিনটিনের মধ্যে “কোমলতা আর অশ্রু – যা ছিল হার্জের কাছে মহিলার সংজ্ঞা।” পরবর্তীতে সেসপেদেস  তাঁর টিনটিনকে ” অযৌন লক্ষণযুক্ত” মেয়ে বলার পেছনে নিজস্ব স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গি থাকার উল্লেখ করেছেন। যাইহোক না কেন জনপ্রিয় টিনটিন চরিত্রের বিভিন্ন দিক টিনটিনকে প্রবল আলোচনার মধ্যে রেখেছে টিনটিন সৃষ্টির ৯৩ বছর পরেও।।

About Post Author