পুরন্দর চক্রবর্তী, সময় কলকাতা : “ভারতবর্ষের একচেটিয়া নেতা গান্ধী ” -তির্যকভাবে তিনিই লিখেছিলেন। আবার ‘ফুল ফুটুক, না ফুটুক আজ বসন্ত’- তাঁরই লেখা।কাল মধুমাসের বা ফুল ফুটুকের স্রষ্টা বিপ্লবী কবি ” সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের আজ জন্মদিন। মানবিক বোধ আর রাজনৈতিক বাণীর অপূর্ব মিশেল ঘটেছে তাঁর কবিতায়।ভিড় করে আসা তাঁর স্মরণীয় কবিতার ফাঁকেও উঠে আসে তাঁর রাজনৈতিক ভাবনা নিয়ে বিশ্লেষণ আর কিছু জমে থাকা বিতর্ক।কথায় কথায় হারিয়ে যায় তাঁর ব্যক্তিগত জীবন।
সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের জন্ম মামার বাড়িতে নদিয়ার কৃষ্ণনগরে। কিন্তু তাঁর জীবন কেটেছে বিভিন্ন জায়গায় । পিতা ক্ষিতীশ মুখোপাধ্যায়ের সরকারি চাকরির সুবাদে কবির ছেলেবেলা কেটেছিল পশ্চিমবঙ্গের পাশাপাশি পূর্ববঙ্গেও । নওগাঁর স্কুলে পড়লেও পরে কলকাতার মেট্রোপলিটান ইনস্টিটিউশন ও সত্যভামা ইনস্টিটিউশনে পড়াশোনা করেন। ভবানীপুরের মিত্র স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করে সক্রিয় রাজনীতির ইচ্ছে নিয়ে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন তিনি।তাঁর আগেই মনেপ্রাণে জড়িয়েছিলেন বাম ভাবধারায়।রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত থাকার ফলে স্নাতকোত্তর পাঠ এগোয় নি ।তেরো বছর বয়সেই বঙ্গীয় প্রাদেশিক কিশোর ছাত্রদল-এর সক্রিয় সদস্যরূপে যোগ দেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়। এই সময় কবি সমর সেন তাকে হ্যান্ডবুক অব মার্কসিজম বইটি পড়তে দেন।তিনি বইটি পড়ে মার্কসীয় রাজনীতির সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেন । ১৯৩৯ সালে লেবার পার্টির সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ঘটে । ছাত্রনেতা বিশ্বনাথ মুখোপাধ্যায়ের কথায় তিনি লেবার পার্টি ত্যাগ করে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সংস্পর্শে আসেন। ১৯৪২ সালে পান পার্টির সদস্যপদ। এই সময় সদ্যগঠিত ফ্যাসিবিরোধী লেখক শিল্পী সংঘের সাংগঠনিক কমিটিতে কবি বিষ্ণু দে-র সঙ্গে যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন সুভাষ মুখোপাধ্যায়। ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে কমিউনিস্ট পার্টি বেআইনি ঘোষিত হলে বহু কমিউনিস্ট বন্দীর সঙ্গে কারাবরণ করেন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ও। এই সময় তিনি সামিল হন দমদম জেলের অনশন ধর্মঘটেও।
কারবাস থেকে মুক্তির পরে বিয়ে সারেন, সঙ্গে অর্থকষ্ট ছিল।১৯৫২ সালে সস্ত্রীক কবি ওঠেন বজবজ এলাকার শ্রমিক বস্তির একটি মাটির ঘরে,আত্মনিয়োগ করেন সেই অঞ্চলের চটকল মজদুর সংগঠনের কাজে। পরে কলকাতার বন্দর অঞ্চলে ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠনের কাজও করেন। ১৯৬৪ সালে কমিউনিস্ট পার্টি ভাগ হলে তিনি থেকে যান পুরনো পার্টিতেই। ১৯৬৭ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকার ভেঙে দেওয়া হলে আন্দোলনে যোগ দিয়ে ১৪৪ ধারা ভেঙে আবার জেলে যেতে হয় তাঁকে।লেখা কিন্তু থেমে থাকে নি। ১৯৪০ সালে ‘পদাতিক’ গ্রন্থে তাঁর আত্মপ্রকাশের পর থেকে বিভিন্ন ধারায় লিখেছেন । সক্রিয় রাজনীতির পাশাপাশি লিখে গেছেন কাল মধুমাস, ছেলে গেছে বনে, জল সইতে সহ অসংখ্য কাব্যগ্রন্থ।একাধারে তাঁর রোমান্টিক কবিতা অন্যদিকে রাজনৈতিক ভাবধারার কবিতা তাঁকে করে তোলে অনন্য। কবিতার পাশাপাশি গদ্য রচনা, রিপোর্টাজ, অনুবাদ সাহিত্য ও কবিতা তাঁকে দিয়েছিলাম খ্যাতি, পাকাপাকি ঢুকে পড়েছিলেন বাঙালির মনে।নাজিম হিকমত, পাবলো নেরুদা, হাফিজের, ফয়েজের কবিতার অনুবাদকে বাঙালির ঘরে জায়গা পায়। রচনায় সবক্ষেত্রে সাবলীল হলেও কবি হিসেবে খ্যাতি ছিল সমধিক। পুরস্কার পেয়েছেন বহু। অ্যাকাডেমি বা জ্ঞানপীঠ পুরস্কার পেয়েছেন। খ্যাতির শীর্ষ ছুঁয়েছেন
তথাপি বিতর্ক তাঁকে ছাড়ে নি।
গ্রামে গ্রামে ঘুরে রিপোর্টাজ তৈরী করা কবির অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ “ফুল ফুটুক ” গ্রন্থ যার প্রাথমিক প্রতিফলন ছিল “আমার বাংলা ” নামে আশ্চর্য গ্রন্থ। আশ্চর্য সব শব্দবন্ধ স্থান পেয়েছে তাঁর লেখায়।
বামপন্থী ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যুক্ত কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক চিন্তাধারায় পরিবর্তন আসে শেষ জীবনে।
সত্তরের দশক থেকে তার রাজনৈতিক মতাদর্শের পরিবর্তন হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে অকুণ্ঠ সমর্থন জোগালেও তিনি পশ্চিমবঙ্গের নকশাল আন্দোলনকে সমর্থন করেননি; কে কোথায় যায় উপন্যাসে এই আন্দোলনের প্রতি তার বিরূপতা ব্যক্ত করেছিলেন। সমর্থন করেন ১৯৭৭ সালের জরুরি অবস্থাকে। এই সময়েই অ্যাফ্রো-এশীয় লেখক সমিতির কাজের চাপে ক্রমশ ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন থেকে দূরে সরে আসতে থাকেন কবি। ১৯৮১ সালে বেশ কিছু রাজনৈতিক প্রশ্নে পার্টির সঙ্গে মতবিরোধ হওয়ায় পার্টির সদস্যপদ ত্যাগ করেন। বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে তার দূরত্ব গভীর হয়, ঘনিষ্ঠতা বাড়ে দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক সংগঠনগুলির সঙ্গে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় লাভ করেন তার সান্নিধ্য।তাঁর এতদিনের রাজনৈতিক মতাদর্শের বিপরীত মেরুর কাছে যাওয়ায় পশ্চিমবঙ্গে কমিউনিস্ট নেতৃত্বের কাছে সমালোচিত হন এ-যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ছিল বিতর্ক। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁর কবিতা থেমে থাকে নি।
ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন অসম্ভব বন্ধুবৎসল, স্নেহপ্রবণ।তাঁর স্ত্রী গীতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তিনমেয়ে ছাড়াও তাঁর জীবনে পশুপ্রেমও যা উল্লেখযোগ্য হয়ে উঠেছে তাঁর বহু স্মৃতি চারণায় । তাঁর পোষ্য বিড়াল যুগল -ধুলো আর বালির জন্য নিজের খাওয়া শিকেয় তুলে তাঁকে অনুষ্ঠান বাড়ি থেকেও রুমালে খাদ্য নিয়ে আসতে দেখতেন ঘনিষ্ঠ কবিরা।তাঁরাই আবার বলতেন বারবার ‘পাড়ার স্ট্যালিনরা’ তাঁকে ছিঁড়ে খেত তবুও তাঁকে নীরব থাকতে হত।নীরেন্দ্র নাথ চক্রবর্তীর কবিতা তাঁর খুব ভালো লাগত। ” সেটা আমি কাউকে বলি নি বললে ওরা আমার দিকে খারাপ চোখে তাকাত।”
সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে শঙ্খ ঘোষ বা সুবোধ’ সরকারের স্মৃতিচারণা ও আলোচনায় জানা যায় “পাড়ার স্ট্যালিন ” নিয়ে তাঁর ক্ষোভের কথা। সুবোধ সরকারকে কথায় কথায় গল্পচ্ছলে তিনি উত্তরবঙ্গ সফরের সময়েও বলেছিলেন,রাশিয়াতে চুরি ডাকাতি ধর্ষণ হয়। ‘সেগুলো আমাদের পাড়ার স্ট্যালিন গুলো লিখতে দেয় নি।’ রাজনৈতিক মতাদর্শের ফারাক এসেছিল শেষ জীবনে, কিন্তু তাঁকে পীড়া দিত তাঁর লেখার ওপরে ‘পাড়ার স্ট্যালিন’দের হস্তক্ষেপ। নতিস্বীকার করেন নি তিনি।তাঁর লেখায় ‘পাড়ার স্ট্যালিন’ আরোপিত স্বাধীনতাহীনতার খেদ হয়তো বিপ্লবী কবিকে নতুন রাজনৈতিক পথ খুঁজতে বাধ্য করেছিল। আজও তাঁর লেখায় তাই মুক্তির স্বাদ।।
More Stories
মহাকুম্ভে সন্ত্রাসের ছায়া! কড়া নিরাপত্তায় মুড়ে ফেলা হয়েছে গোটা উত্তরপ্রদেশ, ‘মাছিও গলতে দেব না’, আশ্বাস যোগীর
আলি সর্দার জাফরি : এক অসামান্য জীবনকথা
আরজিকর হাসপাতাল কাণ্ড : প্রতিবাদী সাহিত্যিক পরিমল দে ফেরাচ্ছেন বঙ্গরত্ন