Home » পুরুলিয়ার অস্ত্র বর্ষন এবং কয়েকটি অমীমাংসিত প্রশ্ন

পুরুলিয়ার অস্ত্র বর্ষন এবং কয়েকটি অমীমাংসিত প্রশ্ন

সময় কলকাতা ডেস্ক:- সালটা ১৯৯৫, ডিসেম্বর মাসের ১৮ । ওই দিন ভোর বেলায় পুরুলিয়ার ঝালদার ঘাটাঙ্গা, বেলামু, মারামু গ্রামের মানুষ দেখতে পান, চাষের খেতে ছড়িয়ে অসংখ্য অস্ত্র। ঘাবড়ে যায় এলাকার সাধারণ মানুষ। খবর যায় স্থানীয় থানায়। ঘটনা স্থলে এসে পুলিশের মাথায় হত। কারণ এত অত্যাধুনিক অস্ত্র তারা এর আগে চোখে দেখেনি।

প্রাথমিক ভাবে, পুলিশ জানতে পারে, একটি বিমান থেকে অস্ত্র বর্ষন হয়েছে।

পুলিশ মাঠ থেকে, উদ্ধার করেছিল, ২৫০০টি একে-৪৭ রাইফেল, ১৫ লাখ বুলেট, বিপুল গোলা-বারুদ, এমনকী রকেট লঞ্চার। অস্ত্রের বেশিরভাগটাই ছিল যুদ্ধাস্ত্র। তবে পুলিশ পৌঁছানোর আগেই গ্রামবাসীদের একাংশ বহু অস্ত্র লোপাট করে দেয়। পরবর্তীকালে পুরুলিয়া-সহ জঙ্গলমহল ,বিহার এবং ঝাড়খণ্ডের বহু রাজনৈতিক সংঘর্ষ এবং খুনের ঘটনায় ওই জাতীয় আধুনিক অস্ত্র ব্যবহারের নজির মিলেছিল। প্রায় তিন দশক আগের ঘটনা, সেই ঘটনা কারণ এবং ব্যাখ্যা আজও অমীমাংসিত।

সেই দিনের ঘটনার সঙ্গে উঠে এসেছে একধিক নাম।
যে অস্ত্র বোঝাই বাক্স উদ্ধার করা হয়েছিল সেগুলির গায়ে লেখা ছিল রাজেন্দ্রনগর, বাংলাদেশ। আর রাজেন্দ্রনগর হল ঢাকা সিটির পাশে গাজিপুরে অবস্থিত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি সেনা ছাওনি। অস্ত্র বর্ষণের ঘটনার দশ দিনের মাথায় জ্যোতি বসুর নেতৃত্বাধীন তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সিবিআইয়ের হাতে তদন্তভার তুলে দেয়। সে সময় মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু বলেছিলেন, এই ঘটনায় আন্তর্জাতিক চক্র জড়িত এবং দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। তাই কেন্দ্রীয় সরকারের এজেন্সিরই তদন্ত করা উচিত।

জানা যায়, অস্ত্র ফেলা হয়েছিল লাতভিয়ার একটি অ্যান্টো নোভ-২৬ বিমান থেকে। বিমানটিতে যাত্রী ছিলেন সাতজন। পাইলট এবং টেকনিশিয়ান-সহ পাঁচজন ছিলেন লাতভিয় নাগরিক। অস্ত্র সংক্রান্ত অ্যাসাইনমেন্টের কাজে যুক্ত ছিল ব্রিটিশ নাগরিক পিটার ব্লিচ এবং ডেনমার্কের বাসিন্দা উয়েস নিলস ক্রিশ্চিয়ান নেলসন অরফে কিম ডেভি। কিম ডেভি ছাড়া বাকি ছ’জনকে ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনী গ্রেফতার করেছিল।

যদিও কিম ডেভি ডেনমার্কের সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া একাধিক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ওই অস্ত্র আধ্যাত্মিক সংগঠন আনন্দমার্গ এবং ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নরসীমা রাওয়ের ইচ্ছায় আনানো হয়েছিল। রাওয়ের উদ্দেশ্য ছিল পশিম বাংলায় সিপিএমের বিরুদ্ধে আনন্দমার্গীদের দিয়ে সশস্ত্র লড়াই শুরু করানো। যাতে আইন-শৃঙ্খলার অবনতির অভিযোগে কেন্দ্রীয় সরকার বাংলায় ৩৫৬ ধারা প্রয়োগ করতে পারে। এবং রাজ্য সরকারকে বরখাস্ত করতে পারে। সেই কারণেই আনন্দমার্গীদের সরবরাহ করতে রাতের অন্ধকারে বিমান থেকে অস্ত্র ফেলা হয়েছিল। যদিও রাতে বিমানের পাইলট আনন্দমার্গের সদর দপ্তর আনন্দনগরের পরিবর্তে অন্য জায়গায় অস্ত্র ফেলে। তবে আনন্দমার্গ কিম ডেভির অভিযোগ অস্বীকার করে।

আনন্দমার্গ হল একটি আধ্যাত্মিক সংগঠন। বিহারের জামালপুরে প্রভাতরঞ্জন সরকার ওরফে শ্রীশ্রীআনন্দমূর্তি ১৯৫৫ সালে এই সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন।

পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, বীরভূমের গ্রামে এই সংগঠনের সঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টির বিবাদ গোড়া থেকে। কমিউনিস্ট দল গুলি আনন্দমার্গের বিরুদ্ধে শিশু পাচারের অভিযোগ তোলে। দু’পক্ষের সংঘাতের ইতিহাস বেশ লম্বা। প্রাসঙ্গিত ভাবে উঠে আসে একটি ঘটনা, ১৯৮২-র ৩০ এপ্রিল কলকাতার বিজন সেতুর ঘটনা গোটা দেশে সাড়া ফেলে দিয়েছিল। বালিগঞ্জ স্টেশন লাগোয়া বিজন সেতুর উপর আনন্দমার্গের ১৬জন সাধুকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার ঘটনায় সিপিএমের দিকে আঙুল ওঠে। যদিও সিপিএম এই অভিযোগ বারবার অস্বীকার করেছে। আনন্দমার্গীরা অস্ত্র আনিয়েছিল বলে প্রচার হলেও তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে বাম সরকার তথা ক্ষমতায় থাকা বাম শরিক দল গুলি কখনও নারসীমা রাওয়ের বিরুদ্ধে পুরুলিয়ার অস্ত্র কাণ্ড নিয়ে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ করেনি।

জানা যায়, ১৭ ডিসেম্বর, লাতভিয়ার এএন-২৬ বিমানটি দুপুরে পাকিস্তানের করাচি থেকে উড়ান শুরু করে। সন্ধ্যায় বারাণসীর বিমানবন্দরে অবতরণ করে। সেখানে তেল ভরে মধ্য রাতে ফের ওড়ান শুরু করে বিমানটি। পুরুলিয়ার উপর পৌঁছয় ভোর রাতে। সেখানে অস্ত্র ফেলে বিমানটি দমদম বিমানবন্দরে এসে তেল ভরে চলে যায় থাইল্যান্ডের ফুকেটের দিকে। একদিন থাইল্যান্ডে থাকার পর ১৯ ডিসেম্বর সেটি চেন্নাইয়ে নেমে তেল নিয়ে ফের করাচির উদ্দেশে রওনা হয়। কিন্তু গুজরাতের আকাশে ভারতীয় বায়ু সেনার দুটি মিগ-২০ বিমান লাতভিয়ার এএন-২৬ বিমানটি চিহ্নিত করে। ধাওয়া করে সেটিকে। বাধ্য করে মুম্বই বিমান বন্দরে নামতে । কিম ডেভি মুম্বই বিমানবন্দর থেকে পালিয়ে যায়। পুলিশ পিটার ব্লিচ ও পাঁচ লাতভিয় নাগরিককে গ্রেফতার করে।

ডেনমার্কে ফিরে গিয়ে ডেভি একাধিক সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন,

মুম্বই বিমানবন্দরের বাইরে তাঁর জন্য এক ভারতীয় সাংসদের ঠিক করে দেওয়া গাড়ি অপেক্ষা করছিল। সেই গাড়িতে প্রথমে পুণে চলে যায়। পরদিন সেখান থেকে ট্রেনে দিল্লি। সেই ব্যবস্থাও করে দেন ওই সাংসদ। কিম ডেভি আরও দাবি করেন, দিল্লিতে গিয়ে সাংসদের সরকারি বাসভবনে গিয়ে রাত্রি বাস করেন। পরদিন দিল্লিতে থেকে পাড়ি দেন নেপালে। কিম ডেভি আরও জায়েছিলেন নেপাল সীমান্ত পর্যন্ত তাঁর সঙ্গী ছিল চার সরকারি নিরাপত্তারক্ষী।

কাঠমাণ্ডু থেকে ডেভি ফিরে যান নিজের দেশ ডেনমার্কে।

ডেভির দাবি, সেই সাংসদ হলেন বিহারের পূর্ণিয়ার তৎকালীন বাহুবলি সাংসদ পাপ্পু যাদব। যিনি আনন্দমার্গের সক্রিয় সদস্য। ডেভির দাবি, প্রধানমন্ত্রী নরসীমা রাওয়ের কথায় পাপ্পু যাদব পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকারকে উৎখাত করার জন্য আনন্দমার্গীদের জন্য ওই অস্ত্র সরবরাহের ব্যবস্থা করেছিল। অস্ত্রের টাকা কে বা কোন সংস্থা দিয়েছিল সে রহস্য সিবিআই উদ্ঘাটন করতে পারেনি। অনেকের দাবি নরসীমা রাওয়ের সরকারের তেমনই নির্দেশ ছিল। পাপ্পু অবশ্য বারেবারেই ডেভির অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

 

 

About Post Author