Home » কলকাতার কোন মিষ্টি লতাজির পছন্দ ছিল?

কলকাতার কোন মিষ্টি লতাজির পছন্দ ছিল?

সময় কলকাতা :

(লতাজির স্মৃতিচারণা করছেন সুমিত্রা রায়)

একথা বলাই বাহুল্য যে লতাজী ছিলেন বিরাট মাপের মানুষ। তাঁর কাছে আমার মত সামান্য মানুষের  সম্পর্ক যেন গভীরতা পেয়েছিল তাঁর কলকাতার দই নিয়ে দুর্বলতায় আর এই কাহিনীর কেন্দ্রে রয়েছেন লতাজির স্নেহের পাত্র ময়ূরেশ সতীশ। লতাজি, ময়ূরেশ আর তাঁদের সঙ্গধন্য দুয়েকটি টুকরো মুহুর্ত আজও রয়েছে আমার স্মৃতির মনিকোঠায়।

দিন চলে যায়, থেকে যায় স্মৃতি।সেবার মুম্বইতে একটি স্টুডিওতে কাজের সূত্রে গিয়েছিলাম। একটি গানের ২৫ টি ভাষায় রেকর্ডিং চলছিল। গান গেয়েছিলেন, উদিত নারায়ণ, সোনু নিগম, কবিতা কৃষ্ণমূর্তি, হরিহরণ।যোগাযোগ হয়েছিল ইন্ডিয়ান আইডল খ্যাত ঐশ্বরিয়ার মাধ্যমে । সবটাই ফোনে ফোনে দিল্লি থেকে।  প্রথমদিন সে টুডিওতে পৌঁছিয়ে দেখলাম ভেতরে দুটি ছবি একটি মা সরস্বতীর আর একটি লতাজীর। আগেই জেনেছিলাম স্টুডিওটির নাম এলএম স্টুডিও, তারপর ভেতরে এতবড় ছবি দেখে বুঝতে পারলাম এলএম স্টুডিও সুর সম্রাজ্ঞী লতাজীর। যাঁরা এসেছিলেন তাঁরা প্রত্যেকেই খুঁটিনাটি বিষয়ে আলোচনার জন্যে কথা বলছিলেন গুরুগম্ভীর এক যুককের সঙ্গে। তিনি বসেছিলেন স্টুডিওর শেষ প্রান্তে তাঁর অফিসে।  খুব কম কথার মানুষ সৌম্য দর্শণ ব্যক্তির নাম ময়ুরেশ সতিশ। সামান্য কথাবার্তার মধ্যেই কি করে জানি না আমাদের মধ্যে গভীর সম্পর্ক তৈরী হয়ে গেল। ময়ুরেশ নিজে গুনী সুরকার এবং লতাজীর সবসময়ের সঙ্গী।

মযুরেশের মাধ্যমেই  লতাজীর পরোক্ষ হয়েছিল। স্টুডিওতে থাকাকালীন লক্ষ্য করতাম দিনের মধ্যে বহুবারই ময়ুরেশের কাছে লতা দিদির ফোন আসত। দিদির ফোন আসলেই আপাত গুরু গম্ভীর ময়ুরেশের মুখের ভাবই পাল্টে যেত। কথাবার্তার রকম শুনে বোঝার উপায় ছিল না ময়ুরেশ সুর সাম্রাজ্ঞী লতাজীর সঙ্গে কথা বলছেন না আমাদেরই ঘরোয়া কোনো দিদির সঙ্গে কথা বলছেন। ফোনের মধ্যে দিয়ে ছিটকে আসত সেই স্বর্ণকন্ঠীর উচ্ছলতা মাখা কথার টুকরো। তাঁর সঙ্গে বাক্যালাপের সময় সর্বদাই ময়ুরেশকে  ফুরফুরে মেজাজে দেখেছি। প্রভুকুঞ্জের বাড়ি ছিল আনন্দেভরা প্রভুকুঞ্জ বাড়িতেও একই রকমের পরিবেশ। উষাজী, মিনাজী, হৃদয়নাথজী এদের সকলকে নিয়ে এক অত্যন্ত আটপৌঢে ঘরোয়া পরিবেশ । আর উষাজীর সাথে আমার ছিল সরাসরি যোগযোগ। সবার মাথার ওপরে ছিল লতাদিদির স্নেহের হাত,ছিল প্রভাব। দিদির বিশেষ কিছু চাহিদা ছিল না। শুধু জেনেছিলাম তাঁর পছন্দ ছিল কলকাতার দই।

 

এমন ও হয়েছে স্টুডিওতে কাজ চলাকলীন দুপুরবেলা ময়ুরেশের জন্য বিশেষ পদ একটু বেশি করেই পাঠিয়েছেন আমি আছি জেনে। তার স্বাদ ও গন্ধ তাঁর গায়কীর মতোই সাবলীল ও স্বচ্ছন্দ্য। স্নেহের স্পর্শ আবার ও এল আর একবার অন্য রূপে অন্যভাবে। লতাজীর পছন্দের একটি টিভি সিরিয়াল হল সিআইডি। একবার তাদেরই এক আর্টিস্টের জন্মদিনের একটি উপহার কিনতে বলেছেন দিদি , সঙ্গে আমাকেও নিয়ে যেতে বলেছিলেন। ময়ুরেশ আমাকে সঙ্গে নিয়ে সে পোশাক কিনতে গেলেন। পছন্দ হওয়ার পর দিদিকে ভিডিওকলে দেখালেন, দিদি তখন একটা আমার জন্য এবং অন্যটি অভিনেত্রীর জন্য বেছে দিলেন।আমি ধন্য হলাম।

 

ময়ুরেশ কলকাতায় এসে আমার বাড়িতে ছিলেন কয়েকদিন।  সেইসময় প্রায়ই দেখতাম, ময়ুরেশ ফোনে বাংলায় অনর্গল কথা বলে যাচ্ছে, মাঝে মাঝে মারাঠীতেও। একদিন জিজ্ঞেস করলাম – তোমার কলকাতার পরিচিতদের সঙ্গে কথা বলছ? ময়ুরেশ আমাকে অবাক করে দিয়ে বললেন , না, দিদির সঙ্গে কথা বলছি।

সেবার ময়ুরেশের কলকাতা থাকাকালীন দুবেলা দিদির ফোন আসত , লতাজি খোঁজখবর নিতেন। ফেরার আগে একদিন ময়ুরেশ জানাল দিদি তাঁর পছন্দের মিষ্টি দই নিয়ে যেতে বলেছেন। আমার আরেকবার নিজেকে ধন্য মনে হল, ছুটলাম পাড়ার দোকানে, ভালো দই-এর সন্ধানে । সঙ্গে এও বললাম এই দই যাবে মুম্বাইতে লতাজীর বাড়িতে। কী আশ্চর্য ! প্রায় অবিশ্বাস্য এরকম একটি কথা এক কথায় মেনে নিলেন দোকানদার। দুহাত কপালে ঠেকিয়ে বললেন আর কিছু বলতে হবে না , আর কিছু বলতে হবে না।

একই অভিজ্ঞতা এয়ারপোর্টেও। ময়ুরেশ দইয়ের দুটো হাঁড়ি নিয়ে এয়ারপোর্টে পৌঁছোলে সেগুলি ফ্লাইটে হ্যান্ড লাগেজে ওঠানোর অনুমতি পেল না । অপ্রস্তুত ময়ুরেশ তাঁদেরকে বাধ্য হয়েই জানালেন এই দই কার জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। অবাক কাণ্ড! এখানেও এয়ারলাইন্স অফিসিয়ালরা ময়ুরেশকে নিশ্চন্ত করল এই বলে, যে এই দই অক্ষত অবস্থায় মুম্বাইতে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব তাঁদের এয়ারলাইন্সের। মনে হয়েছিল শুধু গান নয়, লতাজির নামেও ছিল যাদু। তাঁর স্পর্শে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ছোঁয়ায়  ধন্য হয়েছে আমার মতই প্রতিটি মানুষ। তাঁকে হারানোর ব্যথাও তাই ভারাক্রান্ত করছে সবাইকে।।

(লেখিকা  উত্তর চব্বিশ পরগনার বাসিন্দা হলেও কর্মসূত্রে লতা মঙ্গেশকারের পরিবারের বিশেষত উষা মঙ্গেশকারের স্নেহধন্য, উষা মঙ্গেশকারের সঙ্গে লেখিকার ছবিটি লেখিকার সৌজন্যে প্রাপ্ত )

About Post Author