Home » কোপার্নিকাসের ‘দি রেভলিউসনিবাস অরবিয়াম কোয়েলেস্তিয়াম’ : সত্য এবং ভ্রান্তি

কোপার্নিকাসের ‘দি রেভলিউসনিবাস অরবিয়াম কোয়েলেস্তিয়াম’ : সত্য এবং ভ্রান্তি

পুরন্দর চক্রবর্তী, সময় কলকাতা,১৯ ফেব্রুয়ারি : কতভাবেই না একটি মানুষ নিজেকে বিকশিত করতে পারেন। যখন ধর্ম, ঈশ্বর এবং অপ্রমাণিত বিশ্বাসের উপরে সবকিছু দাঁড়িয়ে ছিল তখন বিজ্ঞান, জ্যোতির্বিজ্ঞান, গণিত ও জ্যামিতি, অর্থনীতি, চিকিৎসাবিদ্যা, রাজনীতি, সাহিত্য এবং অনুবাদ, প্রশাসন সহ বিবিধক্ষেত্রে ১৪৭৩ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করা  যে মানুষটি মানবজাতির সামনে আধুনিকতার ছোঁয়া এনে দিয়েছিলেন তাঁর নাম নিকোলাস কোপার্নিকাস।  পোল্যান্ডের মানুষ তিনি,পোলিশ ভাষায় তাঁর নাম নিকোলাই কোপেনিক – ল্যাতিন ভাষায় যা নিকোলাস  কোপার্নিকাস। এই নামে বিশ্ব তাঁকে চেনে। তাঁকে বিশ্বের মানুষ চেনে  কোপার্নিকাসের যুগান্তকারী সৌর মডেল বা সৌরজাগতিক তত্ত্বের কারণে। তিনিই যে প্রথম বৈজ্ঞানিকভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন পৃথিবী সূর্যের চারপাশে ঘোরে। কোপার্নিকাসের মৃত্যুর কিছুদিন আগে তাঁর বই (দি রেভলিউসনিবাস অরবিয়াম কোয়েলেস্তিয়াম ) প্রকাশ পায়। প্রকাশ পায় এক শাশ্বত সত্য। ১৫৪৩ সালে প্রকাশিত হয়  কোপার্নিকাসের সূর্যকেন্দ্রিক তত্ত্ব বা হেলিওসেন্ট্রিক থিওরি সংক্রান্ত মডেল।

মহাবিশ্ব ও সৌরজগত বলতে আমরা যা বুঝি তার ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ বিচার করলে আমরা দুটি ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি দেখতে পাই। আমাদের পৃথিবী এবং মহাবিশ্বের দুটি মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গি একটি বলে, পৃথিবী হল মহাবিশ্বের কেন্দ্র, যেখানে সূর্য, গ্রহ এবং নক্ষত্রগুলি বৃত্তে ঘুরছে (ভূকেন্দ্রিক তত্ত্ব)। অন্য তত্ত্বটি জানায় যে,সূর্য
সৌরজগতের কেন্দ্র যেখানে পৃথিবী এবং গ্রহগুলি তার চারপাশে ঘুরছে (সূর্যকেন্দ্রিক তত্ত্ব )।

শহীদ হওয়ার ২০০ বছর পরেও বিপ্লবী বীর তিরৎ সিং মেলাচ্ছেন ভারত বাংলাদেশকে

প্রথম তত্ত্বটিকে উপস্থাপন করেছিলেন অ্যারিস্টটল। টলেমিও ছিলেন এই তত্ত্বের প্রচারক। যদিও দুজনের তত্ত্বের  মধ্যে সামান্য প্রভেদ ছিল। গ্রীক দার্শনিক অ্যারিস্টটল (৩২৫ খ্রিস্টপূর্ব )  ছিলেন ভূকেন্দ্রিক তত্ত্বের সবচেয়ে বিখ্যাত প্রবক্তা, যা যুক্তিসঙ্গত বলে মনে হয় কারণ আকাশের বস্তুগুলি পৃথিবীর চারপাশে ঘোরে। তাঁর সময়কালে , অতিরিক্ত বিশ্বাসের কারণে অ্যারিস্টটল পৃথিবীকে কেন্দ্রে রেখেছিলেন। তার দৃষ্টিতে, শুধুমাত্র ৪ টি উপাদান ছিল: পৃথিবী (সবচেয়ে ভারী), জল, বায়ু এবং আগুন (সবচেয়ে হালকা)। তিনি বিশ্বাস করতেন যে “কেন্দ্রের প্রভাবের” কারণে ভারী বস্তুগুলি কেন্দ্রের দিকে আকৃষ্ট হয়েছিল। এই তত্ত্বটি যুক্তিযুক্ত  হিসাবে গৃহীত হয়েছিল এবং শতাব্দীর পরে শতাব্দী ধরে চার্চ একে প্রচার করেছিল। টলেমি কৃত মডেল হিসেবেও পৃথিবীকে মহাবিশ্বের কেন্দ্রে রাখার তত্ত্ব যুগ যুগ ধরে চালু ছিল।যাইহোক, যদিও অ্যারিস্টটলের মডেলটি সহজ এবং মহাবিশ্বকে একটি দার্শনিক সত্তা হিসাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে, টলেমির মডেলটি আরও জটিল কারণ এটি মহাবিশ্বকে একটি ভৌত ​​সত্তা হিসাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে।

পোলিশ জ্যোতির্বিদ নিকোলাস কোপার্নিকাস (১৫৪০-৪৩ সালে ) সূর্যকেন্দ্রিক তত্ত্ব প্রস্তাব করেছিলেন। আদতে , কোপার্নিকাস ও প্রথম নন । সর্বপ্রথম অ্যারিস্টার্কাস  ২৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে   সূর্যকেন্দ্রিক তত্ত্বের প্রচার করেছিলেন কিন্তু তাঁর সময়ে এটি জনপ্রিয় ছিল না। কোপার্নিকাস একটি সূর্যকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছিলেন কারণ এটি গাণিতিকভাবে সৌরকেন্দ্রিক গতিতত্ত্বকে আরও ভালভাবে ব্যাখ্যা করেছিল। এই তত্ত্বে  পৃথিবী এবং অন্যান্য গ্রহগুলি স্থির সূর্যের চারপাশে বৃত্তের আকারে ঘুরছে।কোপার্নিকাস একজন ধর্মপ্রাণ মানুষ ছিলেন, প্রাকৃতিক দর্শন এবং গির্জার উভয় জগতের যুগপৎ সেবা করতে নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন এবং গির্জার বিরোধিতাকারী ফলাফল প্রকাশ করতে দ্বিধাবোধ করতেন। যাইহোক, তার তত্ত্বগুলি অবশেষে সর্বজনীন হয়ে ওঠে যা সেসময়ের অনেক বিজ্ঞানী দ্বারা গৃহীত হয়েছিল।

একথাও উল্লেখ্য, ১৫১৪ সালের আগে কোনো এক সময় সহকর্মীদের কাছে কোপার্নিকাস নিজের সূর্যকেন্দ্রিক তত্ত্বের একটি রূপরেখা প্রচার করেছিলেন। তবে পরবর্তীতে তার ছাত্র রেটিকাস দ্বারা তা করার জন্য অনুরোধ না করা পর্যন্ত তিনি এটি প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নেননি। কোপার্নিকাসের চ্যালেঞ্জ কী ছিল? তিনি গাণিতিকভাবে সাজানো মহাজাগতিকতার আধিভৌতিক প্রভাব সংরক্ষণের সাথে সাথে একটি সৌর বছরের দৈর্ঘ্য আরও মার্জিতভাবে এবং সঠিকভাবে নির্ধারণ করে টলেমিকৃত মডেলের একটি বাস্তব বিকল্প উপস্থাপন করতে চেয়েছিলেন এবং তাই তিনি করেছেন। তথাপি,তাঁর সূর্যকেন্দ্রিক মডেলটি অনেকগুলি টলেমিকৃত উপাদানকে ধরে রেখেছে, যার ফলে গ্রহের বৃত্তাকার কক্ষপথ এবং অভিন্ন গতির মত ভ্রান্তির জন্ম দিয়েছে।

বাস্তবিক অর্থে , কোপার্নিকাসের সূর্যকেন্দ্রিক তত্ত্বের মধ্যে বেশ কিছু জটিলতা ও ভ্রান্তি রয়েছে।প্রথমত, গ্রহগুলি সূর্যের চারপাশে সঠিক বৃত্তে চলে না, তারা উপবৃত্তাকার ও ডিম্বাকৃতি পথে চলে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল যে,সমসাময়িক সৃষ্টিতত্ত্ব এই ধারণাকে উড়িয়ে দেয় যে মহাবিশ্বের একটি কেন্দ্র আছে!বিজ্ঞান আদতে মহাকাশের প্রতিটি বিন্দুকে কেন্দ্র হিসাবে গণ্য করা সম্ভব করে তোলে। তবুও কোপার্নিকাস ছিলেন পথপ্রদর্শক। তিনি-ই তো বুঝিয়েছেন পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে। জন্মের ৫৫০ বছরপূর্তিতে তাই তিনি বড্ড প্রাসঙ্গিক।।

 

About Post Author