Home » গরু পাচারের কথা শুনেছেন কিন্তু কিভাবে পাচার হয় জানেন কি?

গরু পাচারের কথা শুনেছেন কিন্তু কিভাবে পাচার হয় জানেন কি?

সীমান্তে গরু পাচার এই সমস্যা দীর্ঘ যুগের আর সেই সমস্যা সমাধানের চেষ্টা একাধিকবার করা হয়েছে। সীমান্তে লাগানো হয়েছে কাঁটাতারের বেড়া ।প্রতি ১০০ মিটার অন্তর অন্তর একজন বিএসএফ জওয়ান মোতায়েন থাকে অতন্দ্র প্রহরায়। সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়া বরাবর লাগানো হয়েছে হাই মাস্ক লাইট, তা সত্ত্বেও গরু পাচার বন্ধ করা যায়নি।

এখানেই প্রশ্ন ওঠে গরু পাচারকারীরা কিভাবে গরু পাচার করে?

প্রথমে জানতে হবে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের অবস্থান।বাংলাদেশ এবং ভারত একটা ৪,১৫৬ কিমি (২,৫৮২ মাইল) লম্বা আন্তর্জাতিক সীমানা অংশ ভাগ করে, এটা বিশ্বের পঞ্চম দীর্ঘতম ভূমি সীমানা, যার মধ্যে আছে অসম ২৬২ কিমি (১৬৩ মাইল), ত্রিপুরা ৮৫৬ কিমি (২৭৫ মাইল), মিজোরাম ১৮০ কিমি (১১০ মাইল), মেঘালয় ৪৪৩ কিমি (২৭৫ মাইল) এবং পশ্চিমবঙ্গ ২,২১৭ কিমি (১,৩৭৮ মাইল)। এই সীমান্তের একাধিক জায়গায় কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া থাকলেও বহু জায়গায় এখনও কাঁটাতার লাগানো সম্ভব হয়নি। তার কারণ বিভিন্ন জায়গায় সীমান্ত নির্ধারিত হয়েছে নদী অথবা খালকে নির্ধারণ করে। আবার বহু জায়গায় পাহাড়-পর্বত থাকায় সেখানে সামান্য কাঁটাতারের বেড়া দিয়েই সীমান্ত নির্ধারিত করা আছে। যেমন মেঘালয়, মনিপু্‌র, মিজোরাম, দার্জিলিং সহ একাধিক জায়গায় পাহাড়ের কারণে সীমান্ত সামান্য কাঁটাতার দিয়ে নির্ধারিত করা। আবার পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জায়গা আছে যেখানে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে শুধুমাত্র খাল অথবা নদী রয়েছে। ফলে সেইসব জায়গা অসুরক্ষিত অবস্থাতেই আছে। যদিও বিএসএফ মোতায়েন রয়েছে তা সত্বেও তাদের নজর এড়িয়ে চলে গরু পাচার সহ অনুপ্রবেশ এবং সীমান্তে চোরাচালান। মূলত গরু পাচারের জায়গাগুলি হল মালদহের হরিশ্চন্দ্রপুর, মোথাবাড়ি ,গাজল,হাবিবপুর, মুর্শিদাবাদের জলঙ্গি ডোমকল রেজিনগর সহ একাধিক জায়গা। নদীয়ার শিকারপুর, ভোগাইপুর, হুগোলবাড়িয়া ,থানার পাড়া , হৃদয়পুর ,চাপড়া ,বেতাই, বোর্নিও ,তাহেরপুর ,কৃষ্ণগঞ্জ, হাটখোলা সহ একাধিক জায়গা। উত্তর,২৪ পরগনার ঝাউডাঙ্গা আংরাইল, পাঁচপোতা, হাবিবপুর, ঘোজাডাঙ্গা সহ একাধিক জায়গা দিয়ে এখনো চলছে গরু পাচার সহ অনুপ্রবেশ।

কিভাবে হয় এই গরু পাচার

গরু পাচার করার একাধিক পদ্ধতি রয়েছে। প্রথমত, রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কিনে আনা হয় গরু। মংলা হাট ,মধ্যমগ্রাম, দিনহাটা হাট, সহ নদীয়ার বিভিন্ন জায়গা থেকেও কেনা হয় গরু। আবার কিছু গরু পাচার হয় বিভিন্ন বাড়ি থেকে চুরি করা গরু। গরু চোরেদের একাধিক গ্যাং রাজ্য সক্রিয়। রাতের অন্ধকারে বিভিন্ন বাড়ির গোয়াল থেকে এই গরুচোরেরা গরু চুরি করে বিক্রি করে দেয় গরু পাচারকারীদের কাছে। এই সমস্ত চোরাই গরু এবং কেনা গরু নিয়ে আসা হয় সীমান্ত সংলগ্ন কোন গ্রামে ,কোন একজন নির্দিষ্ট ব্যক্তির বাড়িতে। সেখানে অপেক্ষা করা হয় কখন সীমান্ত অসুরক্ষিত থাকবে সেই সময়ের জন্য। যে সময় বিএসএফ জওয়ানের ডিউটি পরিবর্তন হবে সেই সময়টাই হল সবচেয়ে আদর্শ সময় গরু পাচারের। রাত নামলেই সক্রিয় হয়ে ওঠে গুরু পাচারকারীরা। পরপর গরু একসঙ্গে দড়িতে বেঁধে লম্বা করে এক সারিতে নিয়ে কোন ব্যক্তির চাষের জমির উপর নিমেষে সীমান্ত পার করে দেয় গরু পাচারকারীরা। এখানে প্রশ্ন ওঠে যে ব্যক্তির জমির উপর দিয়ে গরু পাচারকারীরা গরু নিয়ে যাচ্ছে তার তো চাষের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে সেক্ষেত্রে কি সেই ব্যক্তি কোন প্রতিবাদ করেনা? এখানেই হলো টুইস্ট। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে এইসব জমির মালিকদের সঙ্গে পাচারকারীদের একটা মাসিক চুক্তি থাকে। অর্থের বিনিময় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই জমির মালিকরা গরু পাচারের জন্য জমি ব্যবহার করতে দেয়। পাশাপাশি বিএসএফ জওয়ানদের সঙ্গেও থাকে এদের অবৈধ সংযোগ। এই সংক্রান্ত বিষয়ে একাধিকবার সীমান্তসংলগ্ন গ্রামের বাসিন্দারা অভিযোগ তুলেছেন। বহু বাসিন্দার অভিযোগ প্রতি গরুতে আড়াইশো টাকা করে নেয় বিএসএফ জওয়ানেরা।

 

গরু পাচারের আরেকটি পদ্ধতি

যে সমস্ত স্থানে সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া রয়েছে সেখান গরু পাচার হয় কিভাবে? এরও অভিনব পদ্ধতি আবিষ্কার করেছে গরু পাচারকারীরা। রাতের বেলায় সীমান্তের কাঁটাতার কেটে তার উপরে ঢেউ টিন বসিয়ে ,সেই টিনের এর উপর গরু চাপিয়ে পার করে দেওয়া হয় সীমান্তের ওপারে। ঝাউডাঙ্গা আংরাইল পাঁচপোতা দিয়ে গরু পাচার হয় মূলত নদী পথ ধরে। রাতের অন্ধকারে বিভিন্ন বাঁশ বাগান অথবা কোন বাগান দিয়ে লাইন দিয়ে গরু নিয়ে গিয়ে নদী পথ ধরে পৌঁছে দেওয়া হয় বাংলাদেশে।

গরু পাচারের ক্ষেত্রে রাজস্ব

এদেশ থেকে প্রতিবছর কয়েক লক্ষ গরু পাচার হয় বাংলাদেশে। আমাদের ভারতবর্ষে গরু পাচার আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। বিএসএফের হাতে কোন গরু পাচারকারী ধরা পড়লে তাকে তৎক্ষণাৎ বিএসএফ তুলে দেয় সীমান্তসংলগ্ন থানার হাতে। সীমান্তের আটক হওয়া গরু বিএসএফের ক্যাম্প থেকেই নিলামে তোলা হয়। বহু ক্ষেত্রে দেখা যায় সীমান্তে বিওপির সঙ্গে অবৈধ লেনদেনের মাধ্যমে এই নিলামে ওঠা গরুই আবার কিনে নেয় গরু পাচারকারী। অর্থাৎ বলা যেতে পারে এ গরু পাচার চক্র একটা অসাধু চক্র, যে চক্রের সঙ্গে জড়িত রয়েছে বিএসএফ, বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা ,সীমান্তে বসবাসকারী বহু মানুষ। কারণ বছরের পর বছর গরু পাচারের সঙ্গে যুক্ত গরু পাচারকারীরা যেভাবে তাদের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে সেক্ষেত্রে কোন রাজনৈতিক নেতার ছত্রছায়ায় না থাকলে সেটা সম্ভব নয়। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতার সে শাসকদল হোক অথবা বিরোধী দল হোক, নাম উঠেছে একাধিক নেতার।

সীমান্ত সমস্যার সমাধানে একাধিকবার একাধিক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে ।তারই মধ্যে ২০১৯ এ উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক হয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত আরো সুরক্ষিত করার জন্য উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন প্রশাসনের বহু উচ্চপদস্থ আধিকারিকরা। বৈঠকে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিব ছাড়াও রাজ্যের মুখ্যসচিব, স্বরাষ্ট্রসচিব, বিএসএফের ডিজি এবং সেনা আধিকারিকরা উপস্থিত ছিলেন। উত্তর চব্বিশ পরগনা, নদিয়া, মালদহ, মুর্শিদাবাদ, কোচবিহার, দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি এবং দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার মতো বিভিন্ন সীমান্তবর্তী জেলার ডিএম এবং এসপি-রা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এই বৈঠকে অংশ নিয়েছে। সীমান্ত সুরক্ষার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার যে সব পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে, তা সবিস্তারে তুলে ধরা হয়। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিবের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ সীমান্তে মোট ৫টি এবং ভুটান ও নেপাল সীমান্তে ১টি করে ইন্টিগ্রেটেড চেকপোস্ট তৈরি হবে। এর মধ্যে রয়েছে জলপাইগুড়ির গজলডোবা, চ্যাংড়াবান্ধা, ফুলবাড়ি, জয়গাঁও, পানিট্যাঙ্কি, মাহাদিপুর এবং হিলি সীমান্ত। সম্প্রতি বিএসএফ-এর অধিকার বৃদ্ধি নিয়ে শুরু হয়েছে কেন্দ্র-রাজ্য সংঘাত। সংঘাতের কারণ সীমান্তের জিরো পয়েন্ট থেকে ৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিএসএফের অধিকার বৃদ্ধি করতে চেয়েছে কেন্দ্র। সেক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে সীমান্তসংলগ্ন রাজ্য পুলিশের ক্ষমতায় হস্তক্ষেপ করবে বিএসএফ এই অভিযোগ তুলে বিএসএফের এই অধিকার বৃদ্ধি মানতে রাজি হইনি রাজ্য। রাজ্য কেন্দ্রে সংঘাত জারি কিন্তু তারই মাঝেই গরু পাচারকারীদের গরু পাচার চলছে অবলীলায়।

About Post Author